ভূগোলের গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১১ জুলাই, ২০২৩ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

সময়ের কথন : রেংগুন

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার কাটিরহাটে আমার বাড়ি। আমার এলাকার তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। লেখাপড়া, চাকরি করেই জীবন শেষ। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিশেষ বিশেষ পকেটে যে রকম প্রচুর ব্যবসায়ী পাওয়া যায় আমাদের এলাকায় তেমন হাইব্রীড ধনী কম। তবে অতীত থেকে বর্তমান ছোটকাল থেকে সাত দশকের এই জীবনে এলাকাকে বিশেষায়িত করতে হলে বলতে হবে আমাদের এলাকা বন্যাপ্রবণ, প্রবাসপ্রবণ আর হাল আমলে ওরশপ্রবণ এলাকা বৈকি।

আমাদের এলাকায় প্রবাস গমন শুরু হয় বার্মা বা মিয়ানমার যখন বৃটিশ কর্তৃক বিজিত হয়ে ভারত বর্ষের সাথে যুক্ত হয়। ১৭৫৭ সালে বৃটিশরা ভারত জয় করে। ভারতে ব্যবসা করে যে মজা লুঠে তা দেখে বৃটিশদের চোখ পড়ে বার্মা মুলুকের দিকে। মূলতঃ মুনাফার লোভে বৃটিশরা বার্মা মুলুকে প্রবেশ করে। ১৮০০ সাল থেকে পর পর ৩টি এংলোবার্মিজ যুদ্ধের পর বার্মা বৃটিশদের দখলে আসে ১৮২৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। ১৮৮৬ সালে বার্মাকে বৃটিশরা ভারতবর্ষের একটা প্রশাসনিক প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বার্মার চাউল, তেল, কাঠ, স্বর্ণ সব কিছুই বৃটিশ কোম্পানী ব্যাপক হারে লুঠ করে। বৃটিশদের সাথে সাথে ভারতের সমস্ত অঞ্চল থেকে লোকজন বার্মা যাওয়া শুরু করে।

বৃটিশরা ভারত দখল করে বড় শহর কোলকাতা, বোম্বাই, চেন্নাই ও দিল্লীকে লন্ডনের অনুরূপ রাস্তা ও স্থাপত্যে (Replica) গড়ে তুলে। প্রাচ্যে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করার জন্য বৃটিশরা রেংগুনকেও লন্ডনের Replica রূপে গড়ে তুলে। রেংগুনের যখন বিস্তৃতি হচ্ছিল তখন সিংগাপুর সামান্য জাহাজ মেরামতের ডক্‌্‌, মালয়েশিয়া পেনাং নিতান্ত চাকফিপাম সমৃদ্ধ কৃষি অঞ্চল ছিল। এমনি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হাতছানি পেয়ে দক্ষিণ ভারত এর লোকজনের সাথে তাবৎ চট্টগ্রামের লোকজন বার্মা পাড়ি দেয়। যেহেতু বার্মা চট্টগ্রাম সংলগ্ন, লুংগি পরা ও ভাতমাছ খাওয়া দুই দেশে একই তাই চট্টগ্রামবাসী Enmasse বার্মা চলে যায়।

আমার এলাকায় বাড়ি ঘরে কোন পুরুষই দেখা যেত না। চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন সকালেসন্ধ্যা যাত্রীবাহী স্টীমার আকিয়াব হয়ে রেংগুন যেত। আমি ছোটকাল থেকেই সকালবিকাল রেংগুনের গল্প শুনে বড় হয়েছি। আমার গল্প শোনার বয়সে বার্মা থেকে সমস্ত বাংগালী বার্মিজ কর্তৃক বিতাড়িত হয়। এসব বিতাড়িত বেকার লোকগুলো বাচ্চাদের সাথে বার্মার গল্প করতো।

আমার দাদা অতি অল্প বয়সে বার্মায় চলে যান। দ্রুত সময়ে এক বিত্তশীলে পরিণত হন। বার্মাকে আপার ও লোয়ার বার্মা নামে ভাগ করা হত। লোয়ার বার্মা রেংগুনসহ ইরাবতী বিধৌত রাখাইন অঞ্চল। আপার বার্মা উত্তরের বার্মার মূল ভূখন্ড ও বার্মিজ রাজাদের শাসিত অঞ্চল। দাদার প্রথম ব্যবসা আপার ও লোয়ার বার্মায় সফট ড্রিংকস সাপ্লাই। প্রধান পানীয় ছিল সোডা ওয়াটার ও লেমোনেইড। বৃটিশ ও বার্মিজরা মদ পানের সাথে সোডা ওয়াটার পান করত। দাদার কোম্পানীর নাম ছিল ইম্পেরিয়াল এরিয়েটেড (aerated) ওয়াটার সাপ্লাইয়ার। এত পূর্বে এরকম একটা নাম কিভাবে অল্প শিক্ষিত মানুষ চিন্তা করল এটা আমার কাছে এখনো বিস্ময়। এই কোম্পানীর অফিস ঠিক ইরাবতী নদীর জাহাজঘাট এর সন্নিকটে ১৭ নং রোডের ৭ নং বিল্ডিং। এটা একটা ছয়তলা ভিক্টোরিয়া স্থাপত্যের বিল্ডিং। যেহেতু জাহাজঘাট থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটার পথ তাই দেশ থেকে রেংগুন আসা মানুষের চাকরি পাওয়া পূর্ব লঙ্গরখানা ছিল এই বিল্ডিং এর ফ্লোরে। যে যেখানে পারে শুয়ে থাকত। চাকরি ঠিক হলে চলে যেত। চট্টগ্রামে স্কুল পালানো ছেলেদের মাবাবা বকা দিলে, পরীক্ষায় ফেল করলে বাড়ি পালিয়ে সোজা সদরঘাট জাহাজঘাট, কোন না কোন পরিচিত মানুষ তাদেরকে বার্মা নিয়ে যেত।

চট্টগ্রাম ও কোলকাতা থেকে রেংগুন এর যাত্রীবাহী স্টীমার লাইনে একচেটিয়া মালিকানা ছিল বৃটিশ মালিকানাধীন ক্যালকাটা বার্মা স্টীম নেভিগেশন কোম্পানীর। ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হলে বৃটিশ যাত্রীবাহী স্টীমার লাইনের বিপরীতে এ.কে. খান সাহেবের শ্বশুর ও ফটিকছড়ির ধর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল বারী চৌধুরী ১৯২৫ সালে বেংগল নেভিগেশন কোম্পানী গঠন করে চট্টগ্রামরেংগুন যাত্রীবাহী স্টীমার সার্ভিস শুরু করেন। বৃটিশদের থেকে কম দামে যাত্রী নেওয়া হতো বলে এই সার্ভিস বেশ খ্যাতি লাভ করে। আবদুল বারী চৌধুরী আমার দাদাকে টিকেট সেলস, স্টীভেডারিং এর একক এজেন্ট দিলে দাদার ব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আবদুল বারী চৌধুরী অনেক চট্টগ্রামের মানুষকে ব্যাংক, বীমা ও কোঅপারেটিভ এর শেয়ার বিক্রি করেন। এই সুবাদে চট্টগ্রামের অনেক মানুষ দ্রুত ধনী হয়ে ওঠেন।

রানী ভিক্টোরিয়া বার্মা সফরে এলে আবদুল বারী চৌধুরী একমাত্র ভারতীয় যিনি রাণীর সাক্ষাত পান ও রাণীকে বার্মার একটা শ্বেত ভালুক উপহার দেন। আবদুল বারী চৌধুরীর অফিসটা ইরাবতী জাহাজঘাটার অদূরে কাস্টমস হাউসের পাশে। বৃটিশরা পোর্ট এলাকার বিচারিক ক্ষমতা (ম্যাজিস্ট্রেসী) বা হেডম্যান শীপ দান করেন নজির আহমদকে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরাবতীর জাহাজঘাটায় ও কাস্টমস হাউসে জাপানিরা বোমা বর্ষণ করে। বার্মিজরা জাপানীদের পক্ষ নেয় আর বাংগালী ভারতীয়রা বৃটিশদের পক্ষ নেয়। এই সময় বর্তমান রোহিঙ্গা বিতাড়ণের মত ভারতীয় খেদাও শুরু হলে চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ ভারতের লোকজন বার্মা ত্যাগ করে। পথেঘাটে বাংগালী বার্মিজ দাঙ্গা হয়। চট্টগ্রামের অনেক মানুষ নিহত হয়। চট্টগ্রামের সাহিত্য পরিবার খ্যাত ফতেয়াবাদের মাহবুবুল আলম সাহেবের ভাই শামসুল আলম সাহেব রেংগুনে দাংগায় নিহত হয়। হেডম্যান নজির আহমদ সারা জীবনের সঞ্চয় ফেলে কেবল পরনের লুংগী নিয়ে প্রাণ ভয়ে রেংগুন ত্যাগ করে। চট্টগ্রামের প্রতি গ্রামে রেংগুন ফেরত মানুষের আহাজারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাঢোলে প্রখ্যাত ধনী আবদুল বারী চৌধুরীদের রেংগুনআকিয়াবের সমস্ত ব্যবসার পরিসমাপ্তি ঘটে। এটাকে বলা হয় Burma Exodus বা বার্মা থেকে বাস্তুচ্যুত। (চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচা শ্রমিকদের মানবেতর জীবন
পরবর্তী নিবন্ধপরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা চাই