মুহাম্মদ হারুন চৌধুরীর লেখা একটা বই “পাহাড় থেকে সমতলে” লেখক একজন সিভিল সার্ভেন্ট। আমজনতার ভাষায় ‘আমলা’ পৃথিবীতে অনেক প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব (আমলা বললে সমগোত্রীয় লোক নাখোশ হবেন) কর্মজীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন। কিসিঞ্জার লিখেছেন-‘ডিপ্লোম্যাচী’, বাংলাদেশের অভিজ্ঞ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা প্রয়াত আলী আকবর খান এর বই Greshhams Law Syndrome & beyond, ভারতের এম.কে. ক এর বুরোক্রেসী গেটস ক্রেজিয়ার, অজয় সিং যাদব এর Why I am not a civil servant– উল্লেখযোগ্য। উপরে উল্লেখিত বাঘা বাঘা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বইগুলোতে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সুললিত ভাষায় বিধৃত হয়েছে। তাঁদের তুলনায় তরুণ মুহাম্মদ হারুন চৌধুরীর ‘পাহাড় থেকে সমতলে’ বইটাও সিভিল সার্ভেন্টদের রচনা সৃষ্টিতে একটা মূল্যবান সংযোজন।
রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা হারুন সাহেব তার বইতে বিভিন্ন ‘আখ্যানভাগ’ অংশ হিসেবে ভাগ করেছেন। আখ্যান শব্দের অর্থ গল্পের প্লট বা সূচনা, কাহিনী বা ইংরাজীতে narrative সরকারি কর্মকর্তা বলে হয়ত ‘মেথডিকেল’ পন্থায় তার কর্ম জীবনের দিনলিপি সাজিয়েছেন। নতুবা সাধারণ পাঠকের জন্য ঘটনা, মানুষ ও সময়ের কথকতাই যথেষ্ট। তবে ‘আখ্যানভাগ’ রূপে লেখকের বর্ণনা বিশেষ স্থান ও তার জনগণ এর সম্বন্ধে একটা ধারণাও পাঠক পেয়ে যান। এটা পাঠকের উপরি পাওনা।
লেখক যে সময় সরকারি পদে যোগ দিয়েছেন সেই সময় এবং বর্তমানেও ‘ক্যাডার’ সার্ভিস এর প্রতি মেধাবীদের আসক্তি লেখকের বর্ণনায়ও ফুটে উঠেছে। লেখক বিভিন্ন পদমর্যাদায় চার বছর পার্বত্য অঞ্চলে কাজ করেছেন। খুটিনাটি তিনি তীব্র পর্যবেক্ষণ করেছেন সমগোত্রীয়দের প্রফেশানাল দক্ষতা–অদক্ষতা, পাহাড়ী–বাংগালী দ্বন্দ্বের ভেতরের কথা, সিভিল–মিলিটারী দ্বন্দ্বের স্বরূপ ইত্যাদি।
বাংলাদেশ–পাকিস্তানে সিভিল মিলিটারী সম্পর্ক সুখকরভাবে অগ্রসর হয়নি। আমাদের দেশেও ৭৫ পরবর্তী দুটো সামরিক শাসনের প্রভাবে রাষ্ট্রের সর্বত্র এই অসম–সম্পর্ক চলতেই থাকে। লেখক বুরোত্রেট হিসিবে ট্রেনিং প্রোগ্রামে এই সম্পর্কের স্বরূপ তিক্তভাবে অনুভব করেছেন। লেখকের ভাষায় ‘warrant of precedence’ এ সিভিলদের রাষ্ট্রীয় মানক্রম কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে সামরিকতন্ত্রের প্রভাবে সামরিক কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রীয় মানক্রম বাড়তে শুরু করেছে।” ট্রেনিং ক্লাসেও সিভিল–মিলিটারী সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক হতো। পৃথিবীর অন্য দেশে এই সম্পর্কটা আইন দ্বারা নির্ধারিত। লেখক পরবর্তী একটি অধ্যায়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সিভিল মিলিটারীর আইনী সম্পর্কের একটি ঘটনার উল্লখ করতে গিয়ে বলেন– সিভিল আধিকারিকই বক্তব্য দিচ্ছেন, আর উপস্থিত সামরিক অফিসার তার প্রতিরক্ষার দায়িত্বে কেবল। তার বিপরীতে পাহাড়ী একটা অনুষ্ঠানে এক বাংলাদেশী সামরিক অফিসারকে মঞ্চে চেয়ার দেয়া নিয়ে তুমুল হৈ চৈ আমাদের প্রশাসন যন্ত্রের সুষ্ঠু চালানোর জন্য একটা অশনি সংকেত বৈকি।
লেখক হারুন সাহেবের মানসিকতা জনগণমুখী, চরিত্র দৃঢ় ও যুক্তিনির্ভর, শ্রেণিগতভাবে তিনি জনতার মনের ভাষার সাথে পরিচিতই ছিলেন মনে হয়। একদিকে ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমল পরম্পরায় প্রাপ্ত সরকারি আইন, অপরদিকে তার সময়ের সিভিল–মিলিটারী ‘ইগোর টানাপোড়ন, আবার নিজের গণমুখী চিন্তার কমিটমেন্ট– এই তিনটি অনুষঙ্গ জনাব হারুন সাহেবকে পুরো পার্বত্য এলাকায় অবস্থানকালে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। ফলে ঘটনা পরম্পরা আর নিজস্ব কথন থাকেনি। হয়ে উঠেছে এক মনোজ্ঞ সমাজ ও রাজনৈতিক চিত্র। হারুন সাহেবের পর্যবেক্ষণ ও আজকের যারা রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারক তাদের জন্য এক বিরাট ও নির্ভরযোগ্য গাইড বুক হতে পারে। হারুন সাহেবের পার্বত্য চট্টগ্রাম অবস্থান কালটা ছিল ছিন্নমূল সমতল অঞ্চলের বাসিন্দাদের পার্বত্য অঞ্চলে পুনর্বাসনের সময়। এটা একটা ক্রান্তিলগ্ন। এ সময়ে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন বিচিত্রসব পরিস্থিতির সামাল দিতে গিয়ে।
পার্বত্য অঞ্চল শেষে তার চাকরি ক্ষেত্র হয় ফেনী, কোম্পানী গঞ্জ। ৯০ এর দশকে পাবলিক পরীক্ষার নকলের যে মহোৎসব ছিল তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় একটি দ্বীনি মাদ্রাসার পরীক্ষা কেন্দ্রে। ছাত্ররা না হয় নকল করবে–কিন্তু তাদের ওস্তাদরা এই নকল করায় সহায়তা করবেন–এটা আইনী যত না তার চেয়ে বেশি হচ্ছে মারাত্মক নৈতিক অবক্ষয়ের ব্যাপার। লেখকের ভাষায় অনিয়মের বিরুদ্ধে তারা যেন এক নিঃসঙ্গ সৈনিক। লেখক কোম্পানীগঞ্জে ও কচুয়ায় ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষপদে চাকরি করেছেন। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী এই তরুণ কর্মকর্তা, গ্রামীণ রাজনীতি তখন রাজনৈতিক বড় নেতা, মন্ত্রী এরাই নিয়ন্ত্রণ করত। ইউনিয়ন পর্যায়েও গরীব জনগণ ব্যক্তিগত ক্রোধ, ধনী স্থানীয় নেতাদের নীরব অবিচারের শিকার হতেন ও খুব কমই আইনী লড়াইয়ে জিততেন। সর্বশেষে স্থানীয় প্রভাবশালীর স্বার্থে মাছ চাষের ঘটনায় তরুণ কর্মকর্তা হারুন সাহেবের ভাগ্যে ঘটে বিপত্তি। সত্যের পক্ষে থাকলেও প্রভাবশালী বড় নেতার আশীর্বাদপুষ্ট নেতাদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় তাকে দ্রুত বদলি করা হয় অন্যত্র। এতে এক রূঢ় বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। গরীব জনগণ, স্থানীয় নেতা, উচ্চ পদের নেতা এই তিনের টানা–হেচড়ায় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আসলেই অনেক কিছু করতে পারেন না। প্রশাসনে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডার এর টানা পোড়ন গত তিন যুগে খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। বিবেক ও ন্যায় বিচারের প্রতিভূ ছিলেন হারুন সাহেব। আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় স্তরে স্তরে যে অসংগতি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় কচুয়ায় থাকা অবস্থায় তিনি নিজেই ভিকটিম হয়ে বদলি হয়ে যান। চার বছরের চাকরি জীবনে সাতবার বদলি হন তিনি।
হারুন সাহেবের ‘পাহাড় থেকে সমতলে’ বইটা সুখপাঠ্য। তার চাকরিকালীন রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণধর্মী বিবরণ নিছক ব্যক্তিগত দিনপঞ্জী না হয়ে উপভোগ্য কথা–সাহিত্যের রূপ নিয়েছে। লেখকের মুন্সীয়ানা ও কথন প্রশংসনীয়।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক।