ভূগোলের গোল

স্বাস্থ্য খরচ : গরিবের কেয়ামত

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ১১:০৪ পূর্বাহ্ণ

স্বাস্থ্যই সম্পদ, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।এসব কথা আগে প্রাথমিক শিক্ষার বইয়ে থাকতো। এখন সেই জায়গায়কম্পিউটার এর বিভিন্ন অংশের নাম,পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্বন্ধে বাচ্চাদের শেখানো হয়। কিন্তু আমজনতার কেউ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন হরেক রকমের স্বাস্থ্যবিল শোধ করতে মানুষ অর্ধমৃত হয়ে যায়। সেই অবস্থাকে হিন্দি ছবির অভিনেতাদের ভাষায় ভালো প্রকাশ করা যায় “কেয়ামত সে কেয়ামত” ।

৪ঠা জানুযারি ২০২২ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ একাউন্টস ১৯৯৭,২০২০ প্রকাশিত হয়। এটা ৯৭ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন । রোগবালাইতে মানুষের পকেটের হাল হকিকত আর সরকারের বরাদ্দকৃত টাকার খরচের বিস্তারিত বিবরণ এতে দেখা যায়। আমাদের দেশ এমনিতেই শ্রেণি বৈষম্যের সমাজ। এরকম সমাজ ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য সেবা প্রত্যাশিত পর্যায়ে দেওয়া কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। সেই ফাঁক ফোকরেই বেসরকারি চিকিৎসা সেবা বিকশিত হচ্ছে।

অর্থনৈতিক বিবেচনায় মানুষের প্রত্যাশা বাস্তবতা বিবর্জিত। (বাংলাদেশে ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য সেবা খাতে জিডিপির ৪% বরাদ্দ ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও ৩.৫ থেকে ৫.৫ এর মধ্যে ছিল এই বরাদ্দ। মাথাপিছু দৈনিক ১২ থেকে ১৭ টাকা (বাংলাদেশ ১২.৫০ টাকা,ভারত এগারো টাকা শ্রীলংকা ১৭ টাকা) সরকার খরচ করে। এই সীমিত সম্পদে সরকারি হাসপাতালে সেবা দেওয়া হয়। বেসরকারি হাসপাতালে খরচ অনেক অসহনীয়ভাবে বেশি। তাই দুই ক্ষেত্রেই জনগণ সংক্ষুব্ধ। বাজেট,সরকার সব পাশ কাটিয়ে এই সংঘাত সরাসরি এসে পড়ে রোগী ডাক্তার সংঘাত রূপে। মুখরোচক সব খবর ছাপানো হয়। পরে স্বাস্থ্য সেবায় দ্বিমুখী অবিশ্বাস একটা আনহেলদি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এক এক দেশ নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা একেক ভাবে দিয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশ বেশি টাকা খরচ করেও আশানুরূপ সেবা দিতে পারছে না। আবার অনেকে অপেক্ষাকৃত কম খরচ করেও ভালো সেবা দিতে পারছে। স্বাস্থ্যসেবার কিছু সূচক অনুযায়ী যেমন অবকাঠামো,ডাক্তার,নার্স সংখ্যা,দক্ষতা, ওষুধের প্রাপ্যতা, রোগীর সন্তুষ্টি ইত্যাদির ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা দানকারী দেশগুলোর র‌্যাংকিং করা হয় ।

২০২১ সমাপ্ত তথ্য মতে স্বাস্থ্যসেবা দানকারী রাষ্ট্রগুলোর মাঝে উত্তম সেবা দানকারী রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে।

.দক্ষিণ কোরিয়া, .তাইয়ান, . ডেনমার্ক, .অস্ট্রিয়া, .জাপান, .অস্ট্রেলিয়া, . ফ্রান্স, .স্পেন, . বেলজিয়াম, ১০. যুক্তরাজ্য।

উত্তম সেবার ক্রম তালিকায় ভারত ১৯তম, যুক্তরাষ্ট্র ৩০তম, শ্রীলংকা চল্লিশতম, নেপাল ৬১তম ও বাংলাদেশ ৮৫ তম।

যুক্তরাষ্ট্র জিডিপির ১৯% খরচ করে ও ১০% খরচ করা ডেনমার্কের সমান স্বাস্থ্যসেবা কেন দিতে পারেনা এটা মার্কিন রাজনীতিতে একটা বড় প্রশ্ন।

২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলেছিল বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ২৪% মানুষ অর্থাৎ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ বিপর্যয় এর মধ্যে পড়ে। প্রতিবছর ৬২ লাখের বেশি মানুষ দরিদ্র সীমার মধ্যে চলে যায়। ব্যয়বহুল হওয়াতে ১৬ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি মানুষ চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকে। এরা ভাগ্যের হাতেই জীবনটাকে সমর্পণ করে।

২০২০ সালে বাংলাদেশে একজন রোগী স্বাস্থ্যসেবার ২৩% পেয়েছে সরকারি খাত থেকে। out of pocket Expenditure (OOPE) অর্থাৎ ব্যক্তির পকেট থেকে গিয়েছে ৬৯% খরচ, এমনিতেই সরকারি হিসেবে করোনা প্রাক্কালে দরিদ্র বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও বিশ্বব্যাপী ব্যক্তি পকেট থেকে স্বাস্থ্য খরচ গড়ে ১৮১৯ % এই উপমহাদেশের বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের উত্তর প্রদেশে ঙঙচঊ নিজ পকেট থেকে খরচ ৭১%, কেরালায় ৬৮%, পাঞ্জাবে ৬৫%, পশ্চিমবাংলায় ৬৯%। আরো শংকার ব্যাপার হচ্ছে প্রতি বছর চিকিৎসা করতে গিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয় পড়ে ভারতে ৫৫ মিলিয়ন অর্থাৎ সাড়ে ৫ কোটি মানুষ দরিদ্র সীমায় পতিত হয়। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবার এহেন অবস্থার তেমন উন্নতির দিকে ও ভারত সরকারের তেমন পদক্ষেপ দেখা যায় না।

এই হ য ব র ল অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি? সরকার সব ঠিক করার চেষ্টা না করে কেবল জটিল রোগগুলোর এবং শুধু অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত গ্রুপগুলোকেই টার্গেট করে কিছু করার চেষ্টা করে এখানে রোগীদেরকে ও সরকারকে মনে রাখতে হবে যে বর্তমান সময়ে যন্ত্রপাতি রিএজেন্ট সব কিছুরই মূল্য বেশি। নিত্য নতুন প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তির ফলে পুরনো যন্ত্রপাতির ব্যবহার অচল। চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধির এটা অন্যতম কারণ। বেসরকারি উদ্যোক্তারাও আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মূল্যবৃদ্ধির শিকার। কাজেই পরিস্থিতি জটিল। আমাদের মত অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন এনজিও আগে বিভিন্ন রকম সেবা দিত। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে এনজিও সাহায্যও কমে গেছে। ক্যান্সার,হৃদরোগ, কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে কর্পোরেটদের পুরো সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি অথবা দক্ষিণ ভারতের প্রাথিতযশা হৃদরোগ চিকিৎসক দেবি শেটির ৫ টাকার ইন্সুরেন্স পদ্ধতির চেষ্টা করা যেতে পারে। অনেক অপ্রয়োজনীয় খাতের ভর্তুকি টা চিকিৎসা খরচ মেটাতে অপারগ গ্রুপকে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই।

আমাদের দেশ স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক ও প্রিভেন্টিভ সূচকে বিশ্ব স্বীকৃত। এখন প্রয়োজন জটিল রোগের চিকিৎসা খরচ কমানোর ও ভর্তুকির উপায় উদ্ভাবন। বাস্তবের এক অসহায় পিতার নির্বিকার আলাপ দিয়ে শেষ করব। তার ছেলের চিকিৎসা বিল এসেছিল ৪ লাখ টাকা। লোকটা বলল, জীবনে আমি ৪০ হাজার টাকা ও একত্রে দেখি নাই । বাড়ি গিয়ে যতদূর পারি জোগাড় করবো। না পারলে ছেলেকে মেরেই ফেলেন। আমি আপত্তিও করব না। কাঁদবো না। এটা এক মর্মস্পর্শী বিষয় বৈ কি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবক্ষেত্রে ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধআজ সাহিত্যিক সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়া স্মরণানুষ্ঠান