ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৭ জুলাই, ২০২১ at ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ভারত-পাকিস্তান: ৭৪ তম স্বাধীনতা উৎসব: নিয়তির বিভ্রান্তি

আগস্ট মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখ ব্রিটিশের ফেলে যাওয়া দুটো দেশ পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট শবে কদরের দিন ছিল ১৪ই আগস্ট ও ১৫ই আগস্ট মানে মধ্যরাত বারোটার আধা ঘণ্টা আগে ও পরে। পাকিস্তানের গভর্নর জিন্নাহ সাহেব বক্তৃতা দিয়ে দিল্লিতে নেহেরুর বক্তৃতায় হাজির হওয়ার কথা ছিল। একে তো সবে কদর তার উপর বক্তৃতার সময় মিলে নেহেরুর বক্তৃতায় পাকিস্তানি মেহমানেরা হাজির হতে পারেনি। কেন রাত বারোটায় স্বাধীনতার পক্ষে তা নির্ধারণ করা হয়। ভারতীয়রা শিক্ষিত,অশিক্ষিত সবাই জ্যোতিষীদের ভবিষ্যৎ বক্তব্য সম্বন্ধে স্পর্শকাতর। ভারতের তাবৎ জ্যোতিষীরা নেহেরু কে লগ্ন ঠিক করে দেয়। কেতাদুরস্ত সাহেব নেহেরু জ্যোতিষীদের বক্তব্য লগ্ন, সময় অপেক্ষা করতে পারেননি। নেহেরু স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রথম বক্তব্যকে বলা হয় ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি বক্তব্য। এই বক্তব্য উন্নত দেশের অর্কিডে এখনো রক্ষিত আছে। নেহেরু এই বক্তব্যটা অনেকটা মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা কিং মার্টিন লুথার জুনিয়র এর বিখ্যাত বক্তৃতা “I have a dream” মত খ্যাতিমান বক্তৃতা,নেহেরুর ইংরেজি বক্তৃতার বাংলা তরজমা হতে পারে ‘ভাগ্যের দুয়ারে’ (দ্বারপ্রান্তে, মিলন কেন্দ্র) যা হোক ব্রিটিশরা ভারতে আন্দোলনের খেলায় টিকতে না পেরে দু‘শ বছরের রাজত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ নেতা উইনস্টন চার্চিল এমন কোন অশালীন বক্তব্য উপমহাদেশের নেতাদের বিরুদ্ধে বাদ রাখেননি। ১৯৪৩ এর বাংলা দুর্ভিক্ষের খবর চার্চিলের কাছে পৌঁছলে চার্চিলের বক্তব্য,এক কোটি মানুষ মরলো না খেয়ে। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী মরেনি। তারপরও চার্চিল থেমে থাকেনি। তিনি বললেন মরেছে তো কি হয়েছে? ভারতীয়রা ইঁদুরের মত বাচ্চা পয়দা করবে। যাহোক ভদ্র নেহরু এসবের কোনো জবাবও দিতেন না। উপমহাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চার্চিল উপমহাদেশে নেতাদের (ROGUE) গুন্ডা বলেছেন। তিনি বলেছেন ৩০ কোটি ভারতবাসীকে আমরা কতগুলো গুন্ডাদের(ROGUE) হাতে ফেলে আসতে পারি না। যাহোক বিগত ৭৪ বছরের স্বাধীনতায় পাকিস্তান, ভারত কি পেল আর কি খোয়ালো এটা নিয়ে এই দুই দেশে বিস্তর গবেষণা হয়। একটা প্রশ্ন হচ্ছে ব্রিটিশ কলোনি না হলে উপমহাদেশে এই ২৭৪ বছরে কি হতো? নোবেল বিজয়ী ভারতীয় বাঙালি অমর্ত্য সেন ২৯ শে জুন বক্তৃতা দেন অক্সফোর্ড, যার শিরোনাম “I illusion of Empire” বাংলায় বলা যায় ব্রিটিশ রাজের বিভ্রান্তি’ অমর্ত্য সেন পাশ্চাত্য বসবাস করেন। ভালোখারাপ সব বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। অনেকে বলেন ব্রিটিশ শিক্ষা, রেল, শিল্পায়ন ইত্যাদি উপনিবেশ এর সুফল। এই যুক্তির বিপক্ষে যারা তারা উপনিবেশ না থেকেও এশিয়ার চীন, জাপান, থাইল্যান্ড গত ২৭৪ বৎসরে যে উন্নতি করেছে তার সাথে ভারত পাকিস্তানের অবস্থানের কোনো তুলনা হয়? তাহলে ব্রিটিশদের আগে ও ২০০ বছর পরে উপমহাদেশের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল তার তুলনা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে কমিনিস্ট কার্ল মার্কস ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথের ভারত নিয়ে প্রবন্ধগুলোর টেনে আনা যায়। ১৯৫৩ সালে কার্ল মার্কস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কে উপমহাদেশের রেল ও শিল্পায়নের জন্য আশীর্বাদ বলেছেন, তাছাড়া ব্রিটিশদের মাধ্যমে ভারতীয়রা পাশ্চাত্য দর্শন, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের সংস্পর্শে আসে। মার্কস ভারতেও শিল্পায়নের দ্রুতগতি আশা করেছেন। ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আশা করেছিলেন- যার কোনটাই হয়নি। উপমহাদেশের ১৮০০ সালের অর্থনৈতিক অবস্থার সুন্দর উত্তর দিয়েছেন অ্যাডাম স্মিথ, অ্যাডাম স্মিথ “The wealth of nations” গ্রন্থে। ১৬৮০ সালে পৃথিবীর অগ্রগতিতে বৃটেনের অংশ ছিল১.৮% , উপমহাদেশের অংশ ছিল ২২.৫ %। ভারতীয় অঞ্চল বিশেষ করে বস্ত্র বাংলার অর্থনীতি অত্যন্ত চমকপ্রদ ছিল। বস্ত্র, রেশম, সিরামিক ও মসলাতে পৃথিবীব্যাপী একচেটিয়া বাণিজ্য করতো ভারত। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজকীয় ফরমান এর অপব্যবহার করে ভারতের সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য ধ্বংস করে নিজেরা বিত্তের পাহাড় গড়ে ব্যক্তিরূপে ও রাষ্ট্ররূপে। ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭ এই পুরো ১০০ বছর উপমহাদেশে প্রবৃদ্ধি ছিল “০”। অর্ধেক ব্রিটিশ পার্লামেন্টারির সদস্যদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে শেয়ার ছিল। ভারতীয় রেল সহ বড় বড় কোম্পানির মালিকানা ছিল ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের ক্ষুধা, দরিদ্র, অশিক্ষা উপহার রেখে ব্রিটিশ রাজের সমাপ্তি ঘটে।
কিন্তু ৭৪ বৎসরের স্বাধীনতায় ভারত-পাকিস্তান কোথায় আছে? চার্চিলের উপমহাদেশের নেতাদের সম্পর্কে উস্মার কোন সুরাহা এখনো হয়নি, গণতন্ত্রের চর্চাও নড়বড়ে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি স্বাধীনতার ৭৪ বছরে ভালো হয়নি। রাষ্ট্রের অসামপ্রদায়িক চরিত্রেরও কিছু অবশিষ্ট নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক হয়েছে উপমহাদেশে।
কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে ব্রিটিশ “লিগেসী” ছাড়াই থাইল্যান্ড, চীন, জাপান আজকে কোথায়? ভারত পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য এখনো রাষ্ট্র থেকে ও “ভাগ্যই” নিয়তি। সমস্যা যেমন অর্থনীতিতে, তেমনি সমাজ ও রাজনীতিতে। ব্রিটিশ পত্রপত্রিকার তাই উপমহাদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির বিপর্যয় নিয়ে “রহস্যময়” কাহিনী ছাপান ব্রিটিশ পাঠকের জন্য। অজান্তেই ব্রিটিশ রাজ্যের মাহাত্ম্য ফুটে ওঠে God save the king-খোদা রাজাকে হেফাজত করুক। এটাই নেহেরুর বিখ্যাত বক্তৃতা “নিয়তির বিভ্রান্তি” -বৃটিশ রাজ ভারতবাসীর স্বাধীনতা হরন করে । কিন্তু সুবিচার, সুশাসন ইত্যাদির কমতি ছিল না। ভবিষ্যতের উপমহাদেশ নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলেন বলেই হয়তো নেহেরু নিয়তিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর জিন্নাহ সাহেব পৃথক রাষ্ট্র করেও সব ধর্মের সমান অধিকার বলে ধর্ম থেকেও নাগরিক সম্মান অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। আসলে দুই নেতাই বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর মৃত্যুর ট্রেন, উদ্বাস্তু স্বাধীনতাকেই বিভ্রান্ত করে ফেলে। নিয়তিই বটে!

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘বুক চিন চিন’ এরপর আবারও ট্রেন্ডিংয়ে পাবেল
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় নবাগত ও বিদায়ী ইউএনওকে সংবর্ধনা