পথ চলার অর্থনীতি
করোনার আর্থসামাজিক ফলাফল মানব ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা। ধনী-দরিদ্র সব দেশেই আর্থসামাজিক বিপদের সম্মুখীন। এ সময়টা আবার আমাদের দেশে বাজেট কালীন সময়। বাণিজ্য-অর্থনীতি-কর ব্যবস্থা সবকিছু নিয়ে কিছু কথাবার্তা হয়। কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। সবাই মোটামুটি একমত যে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এই অগ্রগতির ধরন, গতি, প্রকল্পের প্রায়োরিটি ইত্যাদি বিষয়ে মহান জাতীয় সংসদে প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরাও দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, কেউ কেউ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছেন, দিক নির্দেশনাও দিয়েছেন। তবে বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও ক্রোনক্যাপিটালিজমে যেটা হয়- সবাই ধনী উচ্চ মধ্যবিত্তদের আয়, কর, করছাড় ইত্যাদির কথা বলেছেন। বিগত এক দশক ধরে প্রবৃদ্ধি ও জিডিপি নিয়ে যে একটা কুহেলিকায় ছিলেন অর্থনীতিবিদরা- কিছু কিছু অর্থনীতিবিদ এখন তা থেকে সরে এসে টেকসই উন্নয়ন ও বৈষম্যহীন উন্নয়নের কথা বলেছেন। কাজ হোক বা না হোক এটাও একটা নতুন উপলব্ধি। কারণ ওহপষঁংরাব মৎড়ঃিয এর কোনো বিকল্প বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে নেই। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, আয়, সঞ্চয়, ক্রয়ক্ষমতা, স্বাস্থ্য ব্যয়, অবসর ব্যয়, এইসব ইন্ডেক্স অর্থনীতির সাফল্যের মূল কথা। তাই উন্নয়নের সড়ক থেকে কারা বাদ পড়ছে এটাই বড় প্রশ্ন। কারণ অর্থনীতিবিদরা ব্যাখ্যা দেবার শত বর্ষেরও আগে সমাজ নিরীক্ষার কবি রবীন্দ্রনাথ “হে মোর দুর্ভাগা দেশ” কবিতা উন্নয়নের সড়ক থেকে ছিটকে পড়া লোক সম্বন্ধে বলেছেন।
“যারে তুমি নীচে ফেল / সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে / সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে”
আমজনতার অর্থনীতির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। এর কিছু গবেষণামূলক ও তাত্ত্বিক, কিছু বাস্তবের অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত সাহেবের নেতৃত্বে ও টঘউচ এর সহায়তায় ঘধঃরড়হধষ টৎনধহ চৎড়াবৎঃু জবফঁপঃরড়হ চৎড়মৎধসসব (ঘটচজচ) এর আওতায় করোনা সৃষ্ট বিপর্যয়ের উপর ২০০ পৃষ্ঠার এক গবেষণা পত্র করা হয়েছে। এটা একটা বিস্তারিত গবেষণা। করোনায়বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মনোগত রোগ, কর্ম হারানো, পুষ্টির অপর্যাপ্ত গ্রহণ, নারীর উপর ঠরড়ষবহপব-অনেক বিষয়ের উল্লেখ আছে। বাংলাদেশ সরকারেরও সহায়তা রয়েছে এই গবেষণায়। দেশের ২৯টি পৌর এলাকার ৬০ মিলিয়ন শহরের দরিদ্রের মাঝে এই সার্ভে চালানো হয়। প্রতি পরিবারে কমপক্ষে একজন চাকরি হারিয়েছেন। ১০% নগরের দরিদ্র শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। সংখ্যাটা উল্লেখ না করেই (৪-৬ মিলিয়ন) বলতে হয় নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে। আবার উচ্চ মধ্যবিত্তরা ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের শ্রেণি অধোগমন হয়েছে। সব মিলে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতা ৪০-৬০% কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এবং রপ্তানি বাণিজ্য আশাপ্রদ ভাবে চলছে। এটা বৃহৎ কর্মহারানো জনগোষ্ঠীর উপার্জন বাড়ানোতে কোন ভূমিকা রাখবে না।
গ্রামে হাজার হাজার মানুষ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরৎ আসছে। এসব রেমিটেন্স পাঠানোর যোদ্ধারাই গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তাদের খরচ করার অভাবে না চলছে সিএনজি, না চলছে রাজমিস্ত্রি, না চলছে দিনমজুর। আগে যে প্রাণবন্ত গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল বিগত দুই বছরের কোভিডের ধাক্কায় আহত, ধ্বংস, নয়তো স্থবির। কৃষি বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ। কৃষকের চাষ না করে কোন উপায় নেই, যেহেতু সংগত কারণে বর্তমানে মজুরি বেশি তাই উৎপাদন খরচও বেশি। তাছাড়া কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিকরা ধানী মৌসুমী রোপা, কাটাসহ এক একজন ২০-৩০ দিনের বেশি কাজ পায় না। বাকি পুরো সময় দিনমজুরদের জন্য বর্তমানে কেয়ামত সম অবস্থা।
সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের বহু প্রকল্প। বিস্তর টাকা বিভিন্ন স্তরের নাগরিকরা পেয়েছেন। বিধবা ভাতা, বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী, মেয়ে উপবৃত্তি, বৃদ্ধ ভাতা বহু প্রকল্পের বিগত দুই বছর মানুষ সরকারি সাহায্য পেয়েছে। বণ্টনব্যবস্থায় ত্রুটি আলাদা ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যেহেতু বেসরকারি উদ্যোগে কর্মসংস্থান শ্লথ হয়ে গেছে তাই সরকার সামাজিক সুরক্ষা বলয় থেকে ‘সিলেক্টিভ’ সরে এসে স্থায়ীকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘস্থায়ী উপকার মিলতে পারে। সাহায্য মানুষ যত চায়, তার চেয়েও বেশি চায় -স্থায়ী উপার্জনের ব্যবস্থা। গত দুই যুগ আগে বেসরকারিকরণের যে বাতাস উঠেছিল করোনা বলছে সরকারি কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই। ধনী গরীব সব দেশেই শেষ আশ্রয় খুঁজেছে সরকারি তহবিলে।
এ তো গেল নিম্নবিত্তের অর্থনীতির কথা, বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে নতুন সমস্যা হয়েছে উদ্ভট সামাজিক, আর্থিক ক্রাইম। প্রতিদিন পত্র পত্রিকায় যে সব ক্রাইম দেখা যায় আমাদের মত ধর্ম পাগল দেশে কেন এসব অপরাধ হচ্ছে তা নিয়ে ইতিমধ্যেই মনোবিজ্ঞানীরা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে-গরিবী থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ বেরিয়ে এসেছে। আমরাও এসেছি। কিন্তু এরকম গড়ৎধষষু ইধহশৎঁঢ়ঃ(নৈতিক দেউলিয়া) সমাজ নিয়ে তো মানুষের ‘হাপিনেস ইন্ডেক্স’ শূন্য হয়ে যাবে। ছিন্নমূলরা অর্থনীতিতে নেই। ওদের নিয়ে কি আর লেখা। দোকানের ফুটপাতে নিদ্রাযাপনকারী লোকগুলোকে দেখতে হলে সকালে ফজরের নামাজের পর যে কোন রোডে দেখা যাবে। আজকে ‘আমাদের’ ‘ওদের’ না বলে সবার দেশ বলার সময় এসেছে, নতুবা পশ্চাতে ফেলিছ যারে- সে তোমারে পশ্চাতে টানিবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট