ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | সোমবার , ১৮ জুলাই, ২০২২ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ব্রেইন ড্রেইন : মানি ড্রেইন

দেশ এখন বহু উন্নত দেশের সাথে বিভিন্ন ফ্রন্টে পাল্লা দিচ্ছে। বিশেষ করে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের সরব উপস্থিতি বিশ্ববাজারে। নব্য ধনীদের যেমন অনেক পুরাতন অনভিপ্রেত ‘খাছিয়ত’ বা অভ্যাস যায় না তেমনি এতদূর উন্নয়ন ও অগ্রগতির সিঁড়ি উঠেও কিছু অনভিপ্রেত অভ্যাস বিশ্ব পরিসরে ও জাতীয় গর্ববোধ প্রকাশে বিব্রত করে। এ রকম দুটো ক্ষেত্র ‘ব্রেইন -ড্রেইন’ ও মানি লন্ডারিং বা ‘মানি ড্রেইন; ধন,ঐশ্বর্য যেমন দামি তেমনি মেধাও দামী। বস্তুত: একটা জাতির গর্ববোধে দুটো বড় উপাদান মেধা ও সম্পদ বা ঐশ্বর্য। অনেক মধ্যপ্রাচ্যের দেশ অর্থ সমৃদ্ধ, কিন্তু মেধা সমৃদ্ধ নয়। আবার ইউরোপীয় দেশগুলো মেধা ও অর্থ সমৃদ্ধ। তাই বিশ্বে কদর ও সম্মান দুটোই আছে।

পৃথিবীর অনেক দেশে এখন বাংলাদেশ Diaspora (প্রবাসী গোষ্ঠী) আছে। তারা অনেক উচ্চ পদে তো আসীন। আবার অনেক রাজনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এদেশ থেকে স্বাধীনতার পর থেকেই মেধা পাচার চলছে এবং বর্তমানে তা আরো বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

মেধা পাচার কাকে বলে? শিক্ষিত, মেধাবী নাগরিকরা যখন বেশি বেতন, উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষায় দেশ ত্যাগ করে তাকে মেধা পাচার বলে। মেধাপাচার এর কারণ, প্রতিকার আমার আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু এই মেধাবীরা নিজের দেশের চাকরির ব্যবস্থা, চাকরির পরিবেশ, গবেষণা ইত্যাদিতে আস্থা রাখতে না পেরে উন্নত বিশ্বে পাড়ি দিচ্ছে। এটা দেশের বর্তমান ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ মর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম ২০২০ সালে ১৫-২৯ বছর বয়সের বাংলাদেশী তরুণদের মধ্যে সার্ভে চালিয়ে দেখেছে যে বাংলাদেশের ৮২% তরুণ বিদেশ চলে যেতে ইচ্ছুক। ‘ব্রেইন ব্রেইন’ বা মেধা পাচার শব্দটা প্রথম ব্যবহার করে রয়েল সোসাইটি অফ ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বিপুল সংখ্যক ইউরোপীয় মেধাবী পেশাজীবী, গবেষক আমেরিকা চলে যেতে থাকে। রয়েল সোসাইটি এটাকে ‘ব্রেইন ব্রেইন বলে। ইউনেস্কোর তথ্য মতে গত ১০ বছর যাবত বাংলাদেশ থেকে বছরে ৭০-৯০০০০/ ছাত্র প্রতিবছর উন্নত বিশ্বে চলে যায়। মার্কিন ভিসা তথ্য মতে ২০০৯ এর তুলনায় ২০২১ এ বার্ষিক স্টাডি ভিসা তিনগুণ বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশে ৫৩টি সরকারি ও ১০৩ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে (২০২১)। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রাঙ্কিং Qs মতে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই ৫০০ নং এর ভিতর নেই। এটাও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, শিক্ষা খাতের বাজেট ১৯৭১ পরবর্তী বছরগুলোতে ৩.৫ পর্যন্ত ছিল। বর্তমানে তা ১.৮৩% জাতিসংঘের চাহিদা মত স্টান্ডার্ড শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বাজেট শিক্ষা খাতে ৬% ন্যূনতম বরাদ্দ থাকতে হবে। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, একজন মাস্টার্স ডিগ্রীর পাঁচ বছর মেয়াদী কোর্সে প্রতি ছাত্রের জন্য সরকারের ব্যয় পাঁচ লাখ টাকা, একজন বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার বানাতে সরকারের ব্যয় ১০ লাখ টাকা। একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর পাঁচ বছরের সরকারি খরচ ১৫ লাখ টাকা। বছরে ৯০ হাজার মেধাবী তরুণ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে যারা তাদের জন্য গড় খরচ ৯ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর খরচ ৩০ হাজার ১৯৩.৩৯ কোটি টাকা। সেই হিসেবে মেধার মূল্য বাদ দিলেও সরকারের যা লস হয় তা দিয়ে প্রতি চার বছরে একটা পদ্মা সম সেতু হতে পারে। এই লগ্নিটা সরকারের পুরোই গচ্চা। যুক্তির শেষ নেই। কিন্তু বেলা শেষে looser হচ্ছে জাতীয় গর্ব, জাতীয় বাজেট, জাতীয় উন্নয়ন। নীতি নির্ধারকরা শুধু ব্যবসার দিকে খেয়াল করলে চলবে না। মেধা, গবেষণা, শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন, বিশ্ব ব্যাংকিং এ জায়গা করে নেয়া ইত্যাদি দেশের বর্তমান পর্যায়ে সময়ের দাবি।।

উন্নত বিশ্বে যত ডাক্তার কাজ করছে তার অধিকাংশই ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ইরান এই কয়েকটি দেশের, ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রতি সাতজনে ১ জন আফ্রিকার ঘানার ডাক্তার। এই মেধা পাচার দেশের জন্য অবমাননাকর।

এখন আসা যাক ‘মানি ড্রেইন’, উন্নত দেশগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ব্যাংকে জমা সহ অনেক ক্যাটাগরিতে থাকার অনুমতি বা PR পাওয়া যায়। এসব অর্থলোলুপ দেশের এই সুযোগ পূর্ণ দমে ব্যবহার করে তাবৎ অনুন্নত বিশ্বের ধনীরা। এসব ধনীদের নিজ দেশের সম্পদ কামাই ভালো লাগে। কিন্তু ধনী প্রজন্ম এ দেশে থাকতে চায় না। ধনীরা সবাই বিদেশে ঠিকানা গড়েছেন। এই ঠিকানা গড়তেই ‘মানি ড্রেইন’ হয়। Global Financial Integrity হিসাবমতে ছয় বছরে বাংলাদেশের ধনীরা ৫০ বিলিয়ন ডলার উন্নত বিশ্বে পাচার করেছেন অর্থাৎ গড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার। অবিশ্বাস্য হলেও পাচার হওয়া এই অর্থে দুই বছরে একটি পদ্মা সেতু সম প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।

দেশের গরীব কম নয়। ওদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাস, বিনোদন ও উন্নয়ন সূচকের অংশ। এই যে অর্থনীতির কিছু অসম চিত্র- এগুলো কি বলে? নাগরিকদের একটি অংশ (প্রবন্ধের মেধাবী ও বিত্তবানরা) এদেশে থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না। বর্তমান মুক্ত বিশ্বে এটা হতেই পারে। কিন্তু এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা যে শিক্ষা, ব্যবসা তার বদলে জনগণ কি পাচ্ছে? জনগণের ‘ড্রেইন’ হয়ে যাওয়া সম্পদ বৃহত্তর শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও বিনোদনে যদি ব্যয়িত হয় তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক সূচক কোথায় যেত? এটা ভাববার সময় এসেছে। যার যেখানে ইচ্ছা যাক। কিন্তু জনগণের ব্যয়িত খরচটার হিসাব হওয়া তো নৈতিক ব্যাপার। পৃথিবীর অনেক দেশে মেধাবী ও অর্থ পাচারকারী বা মাদার কান্ট্রি তার জন্য যা খরচ করেছে তা শোধ করার একটা প্রক্রিয়া আছে। যারা এদেশের মাটি আঁকরে পড়ে থাকবে তারাও যেন গর্ব ভরে বলতে পারে আমরাও মানুষ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং প্রসঙ্গ কথা
পরবর্তী নিবন্ধডলার ফের ছুঁয়েছে ১০০ টাকা