সাখাওয়াত হোসেন মজনু : বিরল পরিসর
ষাটের শুরু থেকে ৭৯-৮০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরে একঝাঁক তরুণ ছিল- যারা চিন্তায় ও মননে মোটামুটি পরিশুদ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাদের কেউ রাজনীতিক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ আমলা, কেউ পেশাজীবী ইত্যাদি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই তরুণরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ন্যূনতম ঐকমত্যে সবার মধ্যে একটা সমপ্রীতির ভাব ছিল। এই মেল-বন্ধনে এসব তরুণরা চট্টগ্রামে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন করে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন চাঙ্গা করে রাখতেন। আমি চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার এক বছরের মাথায় সরকারি বৃত্তি নিয়ে পূর্ব ইউরোপ চলে যাই। ১৯৮৫ সালে দীর্ঘ ১২ বছর পরে আবার দেশে ফিরে আসি। তখন এরশাদ আমল। প্রায় হরতাল হত। হরতালে আমরা কিছু পুরোনো বন্ধু-বান্ধব গল্প করতাম। গল্প করার জায়গাগুলো ছিল ব্যাংকার প্রয়াত জামান ভাই, ব্যাংক এশিয়ার খুরশিদ সাহেব, এবি ব্যাংকের আকরাম হামিদ ভাই ও ডাক্তার মাহফুজুর রহমান ভাইয়ের অফিস ও চেম্বার। ষাট থেকে আশির দশকের এই তরুণরা কেউই ফটকা কোন রাজনৈতিক দর্শন ধারণ করত না। তখনও আমরা শোষণ বিহীন বাংলাদেশের বাস্তবায়ন আশা করতাম। আমাদের এসব আলোচনায় সাখাওয়াত হোসেন মজনুও অবধারিতভাবে হাজির হতেন। তিনি সবার ছোট হলেও বন্ধুত্বের গাম্ভীর্যে বয়সকে অতিক্রম করে ফেলেছিল। অতএব মজনু তখন থেকেই একেকটা আইডিয়া বের করতেন। আমরা সবাই সংগঠিত হয়ে তা বাস্তবায়ন করতাম। তখন তিনি নিয়মিত কলাম লেখক হয়ে ওঠেননি। সংগঠক হিসেবে প্রথম সফল পরীক্ষা হয় চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ গঠন। এ ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা হয় ব্যাংকার এস এম খোরশেদের অফিসে। দীর্ঘ ১২০ বছর একটা নামী কলেজে কোন ‘অ্যালামনাই না’ না থাকাটা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তোলে, কেন প্রাক্তন ছাত্রদের সম্মেলন প্রয়োজন তাও গল্প, প্রবন্ধে মজনু প্রকাশ করেছেন। গোটা চট্টগ্রাম শহরের বিশিষ্টজনদের সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্বটা সবাই মজনুকে দেয়। মজনুর সাংগঠনিক টিম-এই টিমের শক্তি অতুলনীয়। চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ গঠনকে কেন্দ্র করে আমারও পরিচয় হয় একঝাঁক উদ্যোগী তরুণদের সাথে। অধ্যাপক খালেদ, ফজলুল সোবহান চৌধুরী, জনাব আতাউর রহমান কায়সার, অধ্যক্ষ রওশন আক্তার, হানিফ আপা, ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার সাহেব আইডিয়া দিতেন, আর মজনু তা বাস্তবায়ন করতেন। বিভিন্ন সমাজকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ মজনুকে দিয়ে অনেক কাজ করায়েছেন।
লেখালেখিতে মজনুর বিষয়বস্তু ছিল গতানুগতিক সাহিত্য সৃষ্টির বাইরে বলয়ে অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতায় তার ছিল ঝোঁক। চট্টগ্রাম শহরের অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনে বিচিত্র সব কাহিনী তার ‘সাম্প্রতিক টুকিটাকি’ কলামে স্থান পেত। চট্টগ্রামের অনেক বিস্তৃত বিদগ্ধ জন, বিস্মৃত ইতিহাস, ঐতিহ্যকে আজকের পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে সাখাওয়াত হোসেন মজনুর তুলনা পাওয়া দুরূহ।
চট্টগ্রাম শহরে মজনু অনেক ধরনের হতদরিদ্র, অত্যাচারিত নারী-পুরুষকে আর্থিক ও আইনি সহায়তা করতেন। এসব করতেন তার বহুদূর – বিস্তৃত প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কানেকশন ব্যবহার করে। আমার কাছে মজনু বিচিত্র ক্যাটাগরির রোগী পাঠাতো। কেউ হতদরিদ্র, কেউ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, শুধু চিকিৎসার বন্দোবস্ত নয়, সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে অনেক উচ্চবিত্তেরও সমস্যা থাকে। মজনু পারিবারিক অশান্তি লেভেলেও কাজ করতেন। এসব ঘাটতে গিয়ে যেসব জটিল সম্পর্ক বেরিয়ে আসত তার উপাদান নিয়েই রচিত হত ‘সামপ্রতিক চট্টগ্রাম ও টুকিটাকি’।
মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে নিজেকে জাহির করে নাই। অনেক পরিবার অকথ্য দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল এসব অকথিত অবর্ণিত বীরদের জীবনগাথা তুলে আনতে মজনু ছিলেন পারদর্শী।
কাজ করতে গেলে মানুষের ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটে। মজনুও হয়তো ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল। বন্ধুমহলে সবাই এসব অনিচ্ছাকৃত বলেই ধরে নিতো। তার কর্মপরিধি এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য চট্টগ্রাম কলেজ ফাউন্ডেশন এর ব্যানারে- কায়েস, কমিশনার সহিদ, শারুদ নিজামসহ কিছু তরুণরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পুরনোদের মধ্যে নিপু ভাই, শাহরিয়ার ভাই, ড. মাহফুজ সেলিম জাহাঙ্গীর ভাইসহ অসংখ্য ষাট-সত্তরের তরুণ এবং আজকের প্রবীণরা সংগঠিত চট্টগ্রাম মজনু যে সাংগঠনিক ঐতিহ্য রেখে গেছেন তার সবচেয়ে সফল ইতিকথা হচ্ছে আজকে ও কিছু নিবেদিত মজনু- প্রেমিক সংগঠিত আকারে বিরাজ করছে। তাদের পক্ষে যে কোনো ভালো কাজ করা সম্ভব। সব মৃত্যুই বেদনার কিন্তু মজনুর অকাল মৃত্যুতে অসংখ্য মজনু বান্ধবদের জন্য আরো বেদনাদায়ক।
মজনুর সাহিত্য সৃষ্টিতে তার সহধর্মিণী কবি মর্জিনা আখতার প্রেরণা যেমন দিতেন তেমনি গ্রন্থগুলোর ভাষা-গ্রন্থনাও দেখতেন। মজনুর সৃষ্টি সমস্ত বইগুলোর গ্রন্থনা, প্রকাশনায় মর্জিনা আকতারের নামও অবিচ্ছেদ্য। অসংখ্য পাঠক, অসংখ্য উপকৃত এবং অসংখ্যমজনুর সহ-বান্ধবদের স্মৃতিতে চিরজাগরুক থাকবে সাখাওয়াত হোসেন মজনু।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক