নালন্দা ও বর্তমান ভারত
ভারত বিশাল দেশ। বড় বড় মেট্রোপলিসকে ছাড়িয়ে দূর-দূরান্তের গাঁ গ্রামে অসংখ্য আজব আজব ঘটনা ঘটে প্রতিদিন। আবার শিক্ষ্যণীয় অনেক ঘটনা ঘটে। রাজনীতি তো আছেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী আর্থিক দুর্দিনে ভারতে একটা কৌতুক প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশ থেকে খারাপ জায়গা আর কোনটা? উত্তর ছিল ভারতীয় রাজ্য ‘বিহার’। এখন অবশ্য সেই কৌতুক অবান্তর। কয়েকদিন আগে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর উপাচার্যদের নিয়ে ঢাকার জাতীয় দৈনিকে একটা তথ্য-ভিত্তিক উপ-সম্পাদকীয় ছেপেছিল। তাতে দেখা যায় অন্তত আটটিতে খণ্ড-কালীন উপাচার্য দিয়ে কাজ চলছে। যেগুলোতে উপাচার্য আছে তাদের মধ্যে অনেকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। ছাত্র-শিক্ষক পরিষদ-ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টানাপোড়নে এক টাল-মাটাল অবস্থা। তবে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি-বেসরকারিগুলোতে অন্য ধরনের এক সমস্যা তৈরি হয়েছে গত এক যুগে। ওখানে দুর্নীতির সমস্যা কম। বেশি হচ্ছে প্রফেসরদের মুক্ত চিন্তা প্রকাশের বিপত্তি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরাসরি প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের কাছে দায়বদ্ধ। বিরুদ্ধ মতবাদ থেকে ও একাডেমিক উৎকর্ষতার উপর জোর দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপ না করার ঐতিহ্য চলে আসছিল সেই নেহরু-ইন্দ্রিরা থেকে বিজেপির নেতা বাজপেয়ির যুগ পর্যন্ত। সমস্যা শুরু হয় মোদি ক্ষমতায় আসার পরে। শুধু উপাচার্য নয়, বিরুদ্ধ মত প্রকাশকারী নামি-দামী অধ্যাপকদেরও সরিয়ে দেওয়া শুরু হয়। বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বহু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রাস্টি বোর্ড কে চাপ দিচ্ছে অমুককে ‘সাইজ’ করো নিয়মে। আমাদের উপমহাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় কনসেপ্ট শুরু হয় বৌদ্ধ আমলে ভারতের বিহারের নালন্দায়। ৫ম শতাব্দি থেকে প্রায় আটশ বছর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার পাদ কেন্দ্র ছিল, তখন অঙফোর্ড, ক্যামব্রিজ এর অস্তিত্ব ছিল না। বৌদ্ধ মগধ রাজাদের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয় হবে জ্ঞানচর্চার, উদ্ভাবনের কেন্দ্র। নালন্দায় সেই পঞ্চম শতাব্দীতে ২০০০ শিক্ষক ছিলেন। ছাত্র আসতো সুদূর চীন, মালয়, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এটা ছিল সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতে এপিজে আবুল কালাম প্রেসিডেন্ট হলে উনি নালন্দা স্টাইলে ইউনিভার্সিটি নতুন করে শুরু করার প্রস্তাব দিলে-ভারত সরকার এবং প্রধানতঃ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থায়নে এই বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় চালু করা হয় ২০১৪ সালে। সবচেয়ে বেশি অনুদান দেয় সিঙ্গাপুর সরকার, চীন-জাপান, থাইল্যান্ডসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশও এতে যুক্ত হয়। বাজপেয়ির আমলেই গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তক্রমে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে নালন্দা ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর করা হয়। ফ্যাসাদ লাগে মোদি ক্ষমতায় আসার পরে। যেসব উপাচার্য মোদির বিরুদ্ধে সমালোচনা করতেন সরকার তাদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে এবং অজুহাত ছাড়াই সরাতে থাকে। ভার্সিটির শিক্ষকদের মুক্ত চিন্তা প্রকাশ করার বিশিষ্ট বলি হন নালন্দার ভিসি অমর্ত্য সেন। মোদি তো কাউকে কেয়ারই করেন না। সম্প্রতি বিজেপির একজন সমালোচক অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষাবিদ প্রতাপ ভানু মেহতা অশোক ভার্সিটি থেকে পদত্যাগ করলে শিক্ষার্থীরা তাকে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনে নামে। এই ভদ্রলোক অশোক ভার্সিটির ভিসি ছিলেন। এটা দিল্লির কাছে হরিয়ানা রাজ্যের সনোপাত নামক শহরে। সর্বভারতীয় রাঙ্কিং এ অনেক সম্মানজনক একটি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতাপ মেহতার সাথে অরবিন্দ সুব্রামনিয়ম নামে আরো একজন নামী প্রফেসরকে ট্রাস্টি বোর্ড রাজনৈতিক কারণে সরিয়ে দেয়। ভারত সরকার এই প্রতাপ মেহতাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড়শোও বেশি একাডেমিকদের এক বিবৃতিতে দারুণ বিব্রতকর অবস্থায় আছে। হার্ভার্ড, কলম্বিয়াসহ বিশ্বের নামি দামী দেড়শর বেশি একাডেমিক রাজনৈতিক কারণে প্রতাপ মেহতার অপসারণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এসব বিশ্ব একাডেমিকদের বক্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জ্ঞানচর্চা করেন। কোন সরকারের বিরুদ্ধে কোন মতামত প্রকাশের সাথে শিক্ষাদানের সাথে বিরোধ, তাকে অপসারণের ভিত্তি হতে পারে না।
আসলে মগধ বৌদ্ধ রাজারাই শিক্ষকদের সমালোচনাকে দমন না করে উৎসাহিত করতেন। তৎসমকালীন মুসলিম শাসকরাই তীব্রভাবে বিরুদ্ধে মত প্রকাশকে চ্যালেঞ্জ করা শুরু করে। বাগদাদে বহু বিরুদ্ধবাদীকে উমাইয়া ও আব্বাসীয়রা অমানুষিক অত্যাচার করে। ইসলামের ৪ শাস্ত্রীয় ইমামকেই বিভিন্নভাবে শাস্তি ও মৃত্যুবরণ করতে হয়। এটা একটা বিশ্বব্যাপী ভাবনা। শিক্ষা ও রাজনৈতিক মত প্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ আঙ্গিকে নতুনভাবে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। পাশ্চাত্য দেশে এটার সমাধান হয়ে গেলেও ভারতসহ বহু কম উন্নত দেশে শিক্ষাঙ্গনের এই সমস্যা রয়ে গেছে এবং প্রকট হচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক