খতরনাক জমানা
যুগ যায়, যুগ আসে। মানুষ বদলায়, নতুন প্রজন্ম জন্মায়, ইতিহাসে দেখতে পাই সম্রাট আলমগীর ওস্তাদের পায়ে পানি ঢালে। মূল্যবোধ এমনি ছিল যে, বাদশা ছেলে কেন ওস্তাদের পা হাত দিয়ে ধুইছে না তাতে উদ্বিগ্ন। এখন কোন্্ জামানায় আছি? উত্তর এক এক জনের কাছে, একেক দেশের কাছে এক এক রকম। অনেক ভাষায় প্রকাশ মূল অনুভূতির চেয়েও বাস্তব। ভারতের ভেলোর শহরের মসজিদের ইমাম সাহেবের ভাষাটাই আমার মনে হয় বর্তমান জীবন ও প্রজন্মের জন্য যুৎসই প্রকাশ। ইয়ে এক খতরনাক জামানা হ্যায়”। খতরনাক এর বাংলা-ইংরেজি রাশিয়ান যাই করেন। খতরনাক জমানাই অনুভূতির বেস্ট প্রকাশ।
প্রতি সকালে যতদূর পারি বাংলাদেশি পত্রিকাগুলোর খবরের শিরোনাম দেখি। অপরাধের এক এক চিত্র দেখে শিউরে উঠি। সরকারি চাকুরে, পেশাজীবী, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী সবাই অবাক করা অপরাধে যুক্ত। লাশ পাঁচ টুকরো করেই প্রেমিকা বউ ক্ষান্ত হয়নি- তার অবলীলায় স্বীকারোক্তি-ছয় টুকরা করার ইচ্ছা ছিল। (বাংলাদেশ প্রতিদিন-১৫.২.২১) আসলেই খতরনাক জমানা। আমার বাসার গলিটা একটা মসজিদের ঠিক পেছনে। বর্তমান মসজিদের পিছনের গেট খোলা, মুসল্লীর হরহামেশা চলাফেরা হয়। বছর পাঁচেক আগে পর্যন্ত গেইট বন্ধ থাকতো। নির্জন গলি ছিল। রোগী ছাড়া তেমন মানুষের চলাফেরা থাকত না। সকাল ৮ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত হরেক রকম দৃশ্য দেখতাম এই গলিতে। এক মহিলা বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে সারা গলি পায়চারি করে প্রবাসী স্বামীর সাথে চিৎকার করে কথা বলতো। যতটুকু শুনতাম মহিলা তার ননদ আর শাশুড়ির যত অপবাদ বলতেই থাকে। দ্বিতীয় এক গ্রুপ যুগল লিঙ্গের মানুষের পায়চারি ও ঘনিষ্ঠ আলাপ। এই যুগল লিঙ্গের মাঝে প্রবর্তক স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম থেকে ও অফিসের থেকে বের হওয়া যুগল লিঙ্গের মানুষ অন্তর্ভুক্ত। একদিন এক যুগলকে বললাম, আপনারা পার্কে যান, এখানে এভাবে পায়চারি দৃষ্টিকটু। যুগল আমাকে জবাব দিলো, আমরা আংকেল আপনার কোন ক্ষতি করছি? ‘খতরনাক জমানা’ বৈকি।
একদিন এক স্কুল পালানো ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র চেম্বারের বাইরে দুপুর একটার দিকে বসেছিল আমি গোসল করে মসজিদে গেলাম। ফেরার পথেও দেখলাম একই জায়গায় বসে মোবাইলে কথা বলছে। দুপুরে একটু ঘুরলাম, ঘুমালাম আছরের নামাজে যাবার সময়ও দেখলাম একই ছাত্র বসা, মোবাইলের টক্্ চলছে। চার ঘণ্টা একই জায়গায় বসা দেখে তাকে বললাম তুমি আমার ঘরের সামনে এভাবে যে বসে আছো। এটা তো ঠিক না। আমি তোমাদের বাসার সামনে এভাবে বসে থাকলে তোমার কেমন লাগবে? ১৬-১৭ বছরের এই তরুণ (চট্টগ্রামের এক প্রখ্যাত আইনজীবীর ছেলে) আমাকে সোজা বলল, আপনি গিয়ে দেখেন। আরেক গ্রুপ তরুণ বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালায়। পুলিশ তাদেরকে থামায় কাগজপত্র, হেলমেট এর জন্য জরিমানা করে। কিন্তু বেপরোয়া চালানো একবার বামে-একবার ডানে চালানোর জন্য কিছু বলে না। ওদের বেপরোয়া চালানোর ফলে কোন গাড়ির সাথে লাগলেই কার দোষ চিন্তা করার ফুরসৎ নেই। তরুণরা লাগায় মারপিট। এসব তরুণ অশিক্ষিত থেকেও খারাপ ব্যবহার করে। ভিকটিম তার বাপের বয়সী হলেও অসভ্য ব্যবহার করে। এরা অধিকাংশই ধনী লোকের সন্তান। কেউ উঠতি বয়সী, কেউ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অসহিষ্ণু উত্তেজনা কাজ করে এই তরুণদের মধ্যে অথচ এরাই যদি জাতির ভবিষ্যৎ হয় তবে আমাদের জাতির ভাগ্য উপরওয়ালাই জানেন। আমজনতার যে সাম্প্রতিক ক্রিমিনাল রেকর্ড তা আইয়ামে জাহেরিয়াতকেও হার মানায়। এ ধরনের ক্রাইম এর বিস্তার রাষ্ট্রসত্তার তো বটেই জাতিসত্তার জন্যও অশনি সংকেত। ধরুন নিজের খাটের নিচে তিনদিন লাশ রেখে চৌকিতে দিব্যি ঘুমানো-(২০ সালে চট্টগ্রাম শহরের ঘটনা), বিচিত্র সব হত্যাকাণ্ড ও বিচিত্র কারণে হত্যা এসবই একটি অসুস্থ সমাজের লক্ষণ। আর যৌন শ্লীলতাহানি থেকে ধর্ষণ এটাও এক বিকৃত চ্যাপ্টার। শিশু-বুড়ো, শ্বশুর-শাশুড়ি, বউ-শালী কোনরকম সামাজিক সম্পর্ক এই ধরনের বিকৃত যৌন লালসাকে প্রতিহত করতে পারছে না। মাঝে মাঝে সমাজ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছেন পত্র-পত্রিকায়, মিডিয়ায়, কিন্তু যৌন অপরাধ তো থামছে না।
ঘুষ-দুর্নীতি আর্থিক কেলেঙ্কারি সবসময়ই ছিল। এটা নিয়ে পাবলিক মাথা ঘামায়েও লাভ নেই। এটা নিজস্ব নিয়মে চলছে-চলবে, কারণ এ ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে রাষ্ট্রের দায়ভারই বেশি। এই আর্থিক নেগেটিভিজম আমার প্রতিপাদ্য বিষয়ও নয়।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ার জনসংখ্যা ৫ কোটি, মাথাপিছু আয় প্রায় ৭ হাজার ডলার। উন্নত দেশ, অর্থনীতিও মজবুত। সে দেশের এক নম্বর সমস্যা মাদক সেবন। প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, সবাই মাদকসেবী। এই জন্য সে দেশে মাদক সেবন বৈধ করা হয়। কিন্তু সমাজ ভেঙে গেছে। পরিবার ভেঙে গেছে, জন্মহার কমে গেছে। পুরো জাতি এক মানসিক অবসাদগ্রস্ত জাতিতে পরিণত। মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে লড়তে মার্কিনড্রোন হামলা প্রথম ব্যবহৃত হয় কলম্বিয়ায়। পরিস্থিতি এমন যে রাষ্ট্র আছে, প্রশাসন আছে, কিন্তু সমাজ নেই, সুস্থ জীবনও নেই।
প্রগতিশীল লেখক বদরুদ্দীন উমর সাহেব প্রায়ই বলেন, বিত্তের উন্নতির সাথে চিত্তের উন্নতি না ঘটলে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপর্যয় অনিবার্য। বাংলাদেশে বিত্তের প্রকাশ যেমন দৃশ্যমান, তেমনি চিত্তের ক্রমবিপর্যয়ও বাস্তব। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবারই সামাজিক বিপর্যয় রোধ করতে হবে।