ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

বায়ান্ন থেকে অদ্যাবধি : ভাষার সংকট
আমাদের দেশের পত্র পত্রিকায় পাকিস্তানের তেমন খবর থাকে না। কিন্তু উপমহাদেশের দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের “এলিট” শ্রেণির মাঝে বেশ সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ইংরেজ প্রভুদের ফেলে যাওয়া অনেক অভ্যেস আমরা আঁকড়ে ধরে আছি। ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবস বাংলাদেশের ইতিহাসের এক আবেগময় ব্যাপার। কিন্তু বর্তমানে এলিট শ্রেণি তো বটেই আম-জনতার মাঝেও যে ইংরেজি ক্রেজ তৈরি হয়েছে তা মহান ভাষার মাসের মর্মার্থ,জাতীয় গর্ব, সংস্কৃতির বিপরীতমুখী ব্যাপার বলে আমাদের প্রজন্মের মানুষরা আঁৎকে উঠি। সমপ্রতি পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের দুটি ব্রান্ড-রেস্টুরেন্টে ইংরেজি ভাষা নিয়ে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে- যার প্রেক্ষাপটে আজকের লেখার অবতারণা।
ইসলামাবাদের দু-জন ‘এলিট’ রেস্টুরেন্টের মালিক তাদের ম্যানেজারকে ইংরেজি শেখার স্পেশাল কোর্সে পাঠান। এই ম্যানেজার দুজনের মাতৃভাষা উর্দু। তবে তারা মোটামুটি ইংরেজি জানতেন ও বুঝতেন। কিন্তু আপার ক্লাস খদ্দেরদের জন্য উচ্চারণ ভংগী ও ‘এলিট’ একসেন্ট (উচ্চারণ রীতি) শেখার জন্য মালিকরা নিজ খরচে ম্যানেজার দুজনকে ইংরেজি কোর্স করান। কোর্স শেষে দুজন ম্যানেজারের এক ইন্টাভিউ রেকর্ড করে মালিকরা ইউটিউবে পোস্ট করে। তাতে মালিকরা তাদের ভাষাজ্ঞানে সন্তুষ্ট হলেও ‘একসেন্টে’ সন্তুষ্ট হননি। এই রেস্টুরেন্টের মালিকরা ম্যানেজার দুজনের বেতন বাড়ান নি কারণ তারা ‘এলিট শ্রেণির একসেন্টে ইংরেজি বলতে শিখেননি। এই পোস্ট ভাইরাল হওয়ায় সাধারণ কাস্টমারগণ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান ও ঐ দুই রেস্টুরেন্ট বয়কট করার আহ্বান জানান। ইংরেজি ভীতিকে বলা হয় ‘এংলো ফোবিয়া’ আর ইংরেজি প্রীতিকে বলা হয় এংলোফাইলিয়া। যে জাতি বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য প্রাণ দিয়েছে মাত্র ২০-২৫ বছরের ব্যবধানে সে জাতিকে কিভাবে ইংরেজি-প্রীতি মোহষিষ্ট করে রেখেছে তা রীতিমত গবেষণার বিষয়। কথাটা হচ্ছে শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে। আজকে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যদি আমজনতার মাঝেও ভোটাভুটি হয় সন্তানদেরকে কোন মাধ্যমে পড়াতে ইচ্ছুক? তবে গোটা জাতিই হয়তো ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে ইচ্ছুক বলে রায় দেবে। এমতাবস্থায় বায়ান্নের শহীদরা যদি আমাদেরকে দেখতে আসতেন, তবে নিশ্চয়ই ভেবে তাজ্জব হতেন- এরা কি বাঙালি? সত্যিই সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ!
আমার পাঁচ বছর বয়সী নাতি সবে একটি স্কুলে নার্সারীতে যাওয়া শুরু করেছে। তাকে যেদিন আম খাওয়াই সেদিন আমি যতই বলি এটা ‘আম’ ও ততই বলে এটা ‘Mango’ আমি যতই বলি ‘গোলাপী রং’, নাতি ততই বলে না,এটা Pink Color। এটা আমাদের শিক্ষার, সমাজের ও রাষ্ট্রের একটা বড় ধরনের সংকট। নীরবে, অবহেলায় গত ৩০-৪০ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘এলিট শ্রেণি শিক্ষার এই সংকট তৈরি করেছে। আর রাষ্ট্র অসহায়ের মত নিস্ক্রিয় রয়েছে।
আমাদের জাতীয় সংগীত এর রচয়িতা নোবেল জয়ী কবিগুরু। রাষ্ট্রীয়ভাবে ও জাতীয়ভাবে সবাই রবীন্দ্রনাথকে বিভিন্নভাবে ধারণ করি। শিক্ষার মাধ্যম কি হওয়া উচিৎ তত্ত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা ছোট্ট প্রবন্ধ গ্রন্থও আছে। মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের গুরুত্ব UNESCO স্বীকার করে ১৯৫৩ সালে। তার আরো ৩০ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে গিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে UNESCO র গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ প্রায় ৬৩ বছর ধরে শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে বিভিন্ন দেশে যে ত্রুটিবিচ্যুতি বের হয়েছে তার একটা বিশ্বব্যাপী রিপোর্ট। “মাতৃভাষা ছাড়া শিশুদেরকে অন্য ভাষায় পড়ানো হলে শিক্ষায় একটা নেগেটিভ এফেক্ট হয়”। – এটাই ছিল ৬৩ বৎসরের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ। বাংলাদেশিরা মানুক-না মানুক তাতে UNESCO র কিছু আসে যায় না।
১৯৭০ সালে নাইজেরিয়ান শিক্ষাবিদ আলিয়ু ফাকুনওয়া ৩০ লক্ষ শিক্ষার্থীর উপর গবেষণা ও ফলো-আপ করে বলেছেন যে, ৬ষ্ঠ বা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের Superiority বিতর্কাতীত বিষয়। এসব ছাত্র পরবর্তীতে শুধু ইংরেজি মাধ্যম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের তুলনায়/অধিকতর প্রতিযোগী হয় ও মেধাবী হয়।
পৃথিবীর অন্যতম বহুভাষী দেশ ও শিক্ষার ইংরেজি প্রীতির দেশ ভারতের ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি NEP ২০২০ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে কমে ৫ম শ্রেণি এবং বেশিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদান জরুরি, মাতৃভাষার মাধ্যমে নিম্ন শ্রেণিতে শিক্ষাদানকে ভারতে NEP Best Pedagogical মেথড বা সর্বোত্তম শিক্ষাদান পদ্ধতি হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ‘এলিট শ্রেণির প্রভাব এত বেশি যে ওদের ইংরেজি প্রীতি শিক্ষার মাধ্যমকে মোহগ্রস্থ করে রেখেছে। সম্পূর্ণ একটা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি জাতির ঘাড়ে চেপে আছে।
ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা নিয়ে একটি অসাধারণ ফিল্ম তৈরি হয়েছে ২০১৪ ইং সালে ভারতে, নাম- ‘হিন্দি মিডিয়াম, এই ছবিতে অভিনয় করেছেন ইরফান খান ও সাবা কমর। ফিল্মটির গল্প লিখেছেন জিনতে লাখানী আর পরিচালনা করেছেন সাকেত চৌধুরী। ফিল্ম বানাতে খরচ হয়েছিল ১৪ কোটি ভারতীয় রুপি। এর আগে এই দুইজন আরো একটি ছবি বানিয়ে নাম করেছিল। এই ছবির নাম “শাদী কা সাইড এফেক্টস”। “হিন্দী মিডিয়াম” ছবিটি ৬৩তম ফিল্ম ফেট্টি ভেলে বেষ্ট ফিল্ম এওয়ার্ড পেয়েছিল।
হিন্দি ফিল্ম এর কাহিনীটা নিম্ন রূপ। রাজ বাত্রা ও তার স্ত্রী মিতা দিল্লীর সম্পন্ন ব্যবসায়ী। তাদের মেয়ে পিয়া। এই দম্পতির বড় ইচ্ছা- দিল্লীর নামী স্কুল “দিল্লী গ্রামার স্কুলে মেয়ে পিয়াকে ভর্তি করাবে, তবে এই স্কুলে ভর্তি হবার কয়েকটি শর্তের মাঝে একটা হল স্কুলে ৩ কিমি দূরত্বের বাসিন্দা হতে হবে। আবার Right to education কোটায় কিছু দরিদ্রের সন্তানও এই স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পায়। কিন্তু রাজ বাত্রা এই দুই শর্তের কোনটাতেই পরে না। স্বামী-স্ত্রী বুদ্ধি করে একটা দরিদ্র এলাকায় বাসা ভাড়া নেয়। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় শ্যাম নামে এক দরিদ্র বাসিন্দার সাথে। শ্যামের ছেলে মোহন ও পিয়ার সমবয়সি কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় রাজ বাত্রার মেয়ে পিয়া টিকে যায়। আর শ্যামের ছেলে মোহন টিকে না। যথারীতি মোহন একটা সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু রাজ বাত্রা সরকারি স্কুলে গিয়ে দেখে যে মোহনও ভাল ইংরেজি জানে। এটা দেখে রাজ দম্পতি সরকারি স্কুলে বিরাট চাঁদা দেয় যাতে আমজনতার সন্তানরা ইনটেনজিভ ইংরেজি শিখে। এখানেই ঘটনার শেষ নয়।
একদিন দিল্লী গ্রামার স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে রাজ বাত্রা অভিভাবকদের পক্ষে বক্তব্যে পুরো ঘটনা বিবৃত করেন। বেলা শেষে দেখা যাচ্ছে যে,মোহন অন্যান্য বিষয়ে পিয়া থেকেও পারদর্শী হয়ে উঠেছে। আর ইংরেজি বিশেষ ইনটেনজিভ কোর্সে শিখে গ্রামার স্কুলের ছেলেদের প্রায় সমান বলে ও লিখে।
ইসলামাবাদ রেস্টুরেন্টের ঘটনাটা প্রমাণ করে কাজ চালানোর জন্য ইংরেজি যতটুকু দরকার তার চেয়েও বেশি দরকার ‘এলিটিজম বা আভিজাত্যের কারণে। এই উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক ‘হ্যাংওভার, ঔপনিবেশিকতা প্রীতির উদাহরণ শুধু শিক্ষার মাধ্যমে নয়, আচার-আচারণে, বেশ ভূষায়ও দৃশ্যমান। কিন্তু সমস্ত গবেষণা, তথ্য-উপাত্তে নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদান যেমন স্বতঃস্ফূর্ত, তেমনি বৈজ্ঞানিক। তারপরেও কেবল এলিটিজম রক্ষার খাতিরে উদ্ভট মেথড উপমহাদেশে চলছে যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। উর্দুপ্রীতিতে উজ্জীবিত ইসলামাবাদের নাগরিকরা ইংরাজি প্রীতির এলিট রেস্টুরেন্ট বয়কট করে মাতৃভাষার জন্য শহীদ হওয়ার এই বাংলাদেশে সর্বগ্রাসী ইংরাজি প্রীতিতে আমজনতার অবস্থা দিশেহারা আজ। শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে সরকারের UNESCO নীতি মোতাবেক পদক্ষেপ জরুরি-যা বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক। শিক্ষার মাধ্যমের এই জগাখিচুড়ি সংস্কৃতি থেকে মুক্তির ভরসা একমাত্র সরকারি উদ্যোগ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান : অসম্ভব অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে দেশটি
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়াকে নান্দনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার