ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

১৬০০ টাকার অর্থনীতি
বৃটিশ নোবেল বিজয়ী বার্ট্রেন্ড রাসেল চিকনা পাতলা ছিলেন। একদিন এক মোটা সোটা লোক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনি এত চিকন কেন?
রসিক বার্ট্রেন্ড রাসেল জবাব দিলেন তোমার মত লোকরা তো সব খেয়ে মোটা হয়ে গেছে। আমি চিকন না হয়ে কি হব? বিদগ্‌ধ জন রাসেল সাহেব এর উত্তরের মাঝে অনেক তত্ত্ব আছে বৈকি। অন্ধের হস্তী দেখার উপমা বাংলার সমাজের একটা তৎকালের সমকালীন উপমা। তদ্রুপ বর্তমান বিশ্বে ডাকসাইটে অর্থনীতিবিদ ও থিংক ট্যাংকের অর্থনীতির সাথে সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষের জীবনের অর্থনীতির বিস্তর ফারাক আছে। অনেকটা অন্ধের হস্তীদর্শনের মতো ব্যাপার। আমাদের মতো বৈষম্যময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনের অর্থনীতি ভিন্ন। তাই অর্থনীতির সাফল্য বিপর্যয়ও মনে হয় ভীষণভাবে আপেক্ষিক। তাইতো এই বাংলাদেশেই অতীতের এক কর্তা ব্যক্তি চাউলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় মানুষকে ভাত না খেয়ে কেক খেতে বলেছিলেন।
আমাদের দেশের হারানো লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে একটা অনন্য আইটেম হচ্ছে কবি গান। এই ছন্দময় তর্ক পৃথিবীর অন্য কোন সংস্কৃতিতে নেই। হেন কোন বিষয় নেই যে কবি গানের বিষয়বস্তু হত না। তবে জনপ্রিয় আইটেম ছিল ‘একাল-সেকাল’ রাজা প্রজা ইত্যাদি। রাজা প্রজার বিষয় নিয়ে এক কবি গানের একটি পংক্তি আমার কানে এখনো বাজে।
“ফাডা কাঁথায় শুয়ে দেখ লাখ টাকার স্বপন” চট্টগ্রামী ভাষার অনুবাদ ছেঁড়া কাঁথায় বসবাস করে লাখ টাকার স্বপ্নের কোন মূল্য নাই। আসলে শ্রেণী বিভাজিত সমাজে, বৈষম্য পূর্ণ সমাজে অর্থনীতির ফেরীওয়ালারা এক একজনের কাছে একেক স্বপ্ন বিক্রি করে। আমজনতার অর্থনীতির স্বপ্ন তো বেগম পাড়া কানাডা বা ক্যাসিনোর সম্রাট বা পাঁচ হাজার টাকার বালিশ পার্টির স্বপ্ন থেকে আলাদা হবেই। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য বিশ্লেষণের জিডিপির তত্ত্বে প্রান্তিক মানুষের কথা প্রান্তিকেই থেকে যায়।
এমনি একজন প্রান্তিক মানুষ কসির মিয়া। বাড়ি কুড়িগ্রাম। বর্তমান বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। ২২-২৩ বছরে যুবক অবস্থায় এই বড় লোকের শহর চট্টগ্রামে আসে। দিন মজুর হিসেবে গতর খাটে চট্টগ্রামের। সূর্য ওঠে নতুন দিনের আশায়, সূর্য ডোবে কসির মিয়ার ক্লান্তির অবসান ঘটিয়ে। এসব বড় শহরে গরবীদের থাকার খরচটা খুব বেশি। তাই উত্তর বঙ্গ বা চর অঞ্চলে মানুষ মায়া অনেক আশা নিয়ে বড় শহরে এসে যৌবন শক্তি বিলিয়ে দিয়ে চমক লাগানো নগরী গড়ে তোলে জীবনের অনেক বছর পর তারা যেই শূন্য হাতে এসেছিল সেই শূন্য হাতেই আবার যৌবন পর্ব শেষ করে। কসির মিয়াও এরকম প্রাপ্তিক কাফেলার যাত্রী। এই কাফেলায় আপনি শুধু চলবেন, একদিন নিঃশেষ হবেন। যে কোন জীব বাঁচার জন্য জীবনের সংগ্রাম পর্ব চালিয়ে যায়। কিন্তু কসির মিয়াদের কাফেলায় ওরা চলে শ্রম দেয় মৃত্যুটাকে কিছু বিলম্বিত করার জন্য।
কসির মিয়ার পয়সা জমে না তেমন। তাই সুদূর কুড়ি গ্রাম ফি বছর যাওয়া হয় না। তবুও বিয়ে পর্ব সারে নিজ ভূমিতে। বউ নিয়ে আসে চট্টগ্রামে। এখানে অনেক কাজ। গার্মেন্টস, বুয়া কত কাজ। হাতের মেহেদী শুকোনের আগেই কসির মিয়ার বউ কাজে লেগে যায়। দু’জনের রোজগার। কিন্তু সব খরচ হয়ে যায় বাসা ভাড়ায়। এসবের মাঝেই জন্ম হয় দুটো মেয়ে।
দেহ শ্রম এক সময় কসির মিয়া আর সইতে পারে না। ফুটপাতে চা বিক্রি শুরু করে স্বউদ্যোগে ব্যবসা। যাতে অর্থনীতিবিদরা ‘ইনফরমাল’ সেক্টর বলে। বাংলাদেশের ৮৫% মানুষ এই ইনফমাল সেক্টরে কর্মরত। তারাই সৃষ্টি করে বৃহৎ পুঁজিতে সৃষ্টি পণ্যের চাহিদা। দেশের জিডিপিতে এই ইনফরমাল সেক্টরের অবদান অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। অথচ এই সেক্টরে লোকজনই কোন অদৃশ্য খরচ মেটাতে যেমন চিকিৎসা, বাচ্চাদের খরচ, বিয়ে শাদী, প্রান্তিক অথবা নিম্ন বিত্তে পতিত হয় কারো ভাগ্য ক্লিক করে, কেউ ধুকে ধুকে মরে। কসির মিয়া এই ২য় গ্রুপে।
দুটো মেয়ে বিয়ে দিতে বেশ দেনা হয়ে যায় কসির মিয়ার। তারপরও ফুটপাতে চায়ের ব্যবসা দিয়ে জীবন চলে। একদিন কসির মিয়া দেখে পৌর কর্তৃপক্ষ কর্মকর্তা নিয়ে সব দোকানিকে ফুটপাত থেকে দোকান সরাতে বলে। কারণ রাস্তা প্রশস্ত করা হবে। ড্রেন হবে। এই প্রান্তিক স্বউদ্যোক্তাদের কি হবে, এই খাবে তা দেখার কোন কর্তৃপক্ষ ‘এলিট’ রাষ্ট্রে থাকার কথা নয়। কসির মিয়ার শরীরে এখন আগের মত আর জোর নেই সে দিন মঞ্জুরী করবে। কয়দিন ব্যাটারি রিকশা চালাচ্ছিল। এই ব্যাটারি রিকশা বৃদ্ধ বেকারদের জন্য ভালো রোজগারের উপায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাও বন্ধ করে দেয়। রীতিমত উপোস থাকতে হয় মাঝে মধ্যে। বেকার মানুষের জন্য শহরে রিকশা চালানোটাই আয়ের সোজা পথ। কসির মিয়া আবারো সেই পা চালানো রিকশা শুরু করে। কিন্তু ‘যাবেন স্যার’? বলে ডাকলেও তার বয়স দেখে যাত্রীরা উঠতে চায় না। বুড়ো মানুষের রিকশা চালানোতে অনেক যাত্রী ভরসা পায় না। এসব হতভাগ্য মানুষের হার্টের রোগও বোঝে না, শ্বাসের রোগও বোঝে না। বাঁচতে হলে রিকশা চালাতেই হবে। অনেক বয়স্ক রিকশা চালক কিছুদূর গিয়েই বসে পড়ে। একটু বিশ্রাম নেয়। কোন যাত্রী যা পারে তা দিয়ে নেমে নিজ গন্তব্যে চলে। কেউ চিন্তাও করে না। কসির মিয়াদের কি হল?
কোন কোন যাত্রী রিকশাওয়ালাদের সাথে গল্প করে। এসব যাত্রীরা কসির মিয়ার গল্প শোনে। এই বয়সে কসির মিয়া কি চায়? বুড়া চালকের রিকশায় মানুষ উঠে না। এটাই তার আফসোস। কোনদিন ১০০ টাকাও পায় না। তার ইচ্ছা আবারো যে কোনখানে বসে চা বিক্রি করবে। পুরোনো এই ব্যবসা শুরু করতে বড় ফ্লাক্স, চা পাতা, চিনির পোটলী, গ্লাস, ছোট্ট গ্যাসের চুলাসহ কমপক্ষে ষোলশত টাকা মূলধন প্রয়োজন। কিন্তু সে মতেই ঐ ষোলশত টাকা জমাতে পারে না। কষ্টের কাজ রিকশা চালানোও ছাড়তে পারে না।
গল্পের এখানেই শেষ। কসির মিয়াদের অর্থনীতি গোল্ডেন সাকস, ইমার্জিং টাইগার এর অর্থনীতিতেও নাই। অনেকে হয়তো বলবেন এরকম মানুষ তো থাকবেই। ইসলাম তো মার্ঙবাদ থেকেও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতি কঠোর। কেউ গরীব হয়ে জন্মায় না। তাহলে সম্পদের অসম বন্টন ও সঞ্চয়ই বহু কসির মিয়ার জন্ম দেয়। সব ‘অপসন’ খেলার সমাজে সব চেয়ে প্রয়োজন দায়বদ্ধতা। নতুবা-
সিক্ত যাদের সারা দেহমন
মাটির মমতা রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল
রবে তাহাদেরই বশে।
আমরা যারা আমাদের অর্থনীতি নিয়ে চর্চা করি তাদের মনে রাখতে হবে। ‘এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধমৃত্যুবার্ষিকীতে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে দুই মাস পর যুবকের লাশ উত্তোলন