করোনাকালের ডায়েরি
কমিউনিস্ট মতবাদের মনীষী কার্ল মার্ঙের উক্তি-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই সমাজের সকল দিকের চালিকাশক্তি। যে কোন ‘বিপ্লবের’ও অন্তর্নিহিত কারণ অর্থনৈতিক। প্যানডেমিক করোনাকালীন জীবন, সামাজিক আচার ও অর্থনৈতিক ‘ফল-ডাউন-এর সাথে সম্পর্কিত।
অর্থনীতি, রেমিটেন্স, জিডিপির যেমন অনেক হিসেব-নিকেশ আছে যা নিয়ে সদা-ব্যস্ত অর্থনীতির গবেষকরা। আমি দেশের অর্থনীতি বোঝার একটা ‘গ্রাম্য’ পদ্ধতি বুঝি। করোনা নিয়ে ডাক্তারি গবেষণার অন্ত নেই। নিত্য নতুন তথ্য আসছে। করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়েও গবেষণার অন্ত নেই।
আমার এলাকার অর্থনীতি প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য নির্ভর। অনেক ঘরে কোন পুরুষ লোক নেই। সবাই মধ্যপ্রাচ্যে। দেশের অর্থনীতি যে চাংগা তা আমি বুঝি এলাকায় কেমন ‘মেজবান’ এর দাওয়াত হয় তা দেখে। পাড়ায় একই সময়ে বেশি দাওয়াত থাকলে বোঝা যায়-পরিবারের একজন এক দাওয়াত এটেন্ড করে। দেশের অর্থনীতি বোঝার আরেকটা উপায় হল গ্রামে শুক্রবার জুমার নামাযে যে ‘দানবাক্স’ চালানো হয় তার অবস্থা দেখে। এখন এই দানবাক্সের কালেকশন ভাল না। গ্রামে আমি শুক্রবার মসজিদের দানবাক্সের অবস্থা খারাপ দেখেছিলাম ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময়। পাড়ার সব মধ্যপ্রাচ্যবাসী চাকরি হারায়ে দেশে। বেতন নাই, দিরহাম নাই-মসজিদের দানবাক্স ভরবে কিসে? করোনাকালে আমার এলাকায় মেজবানও কম, দান বাক্সের অবস্থাও ভাল না, অতএব অর্থনীতির পেপার, টকশো না শুনেই বলা যায় দেশের অর্থনীতি কেমন চলছে?
উল্টো দিকও আছে। লকডাউন শুরুর পরের দিন ফুটপাত সয়লাব হয় মাস্ক, গ্লাভস ব্যবসায়। কাঁচাবাজার যেতে মানুষের অনীহা। অতএব বেড়ে গেল-ভ্যান এ করে সবজী, মাছ ব্যবসা, বাংলাদেশের মানুষের এটা একটা অদ্ভুত দক্ষতা। ‘বিপদে ন ডরাই’। পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবন। খেটে খাওয়া মানুষরা ভ্যান গাড়িতে রোদে পুড়ে ব্যবসা করেছে। না খেয়ে মরেনি। সরকারি প্রণোদনারও অপেক্ষা করেনি।
তার বিপরীতে শিক্ষিত লোকজনের অনেকে মৌসুমী ব্যবসায়ী হয়েছে জেনে শুনে। তারা নকল মাস্ক, নকল ওষুধ থেকে নকল স্যানিটাইজেশন কিনা সাপ্লাই দিয়েছে? এই চক্রে শুধু এক ডা. সাবরিনা কেন-অনেকেই যুক্ত ছিল। যে যে দামে পারে ডাক্তারদের পিপিই বিক্রি করেছে। ১১৫ টাকা থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। আবার অনেকে এক পিপিই দিয়ে পাঁচজন রোগী দেখেও প্রত্যেক রোগী থেকে আলাদা পিপিই’র দাম নিয়েছে। মোট কথা করোনায় অর্থনৈতিক ব্যবসাও জমজমাট ছিল। এখানেও সত্য মার্ক্সীয় উক্তি, অর্থনৈতিক লাভের পিছে ছুটে মানুষ অমানুষ হয়েছে।
যারা নিম্ন বেতনভোগী মানুষ ছিল করোনায় তাদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। অনেকে বাচ্চা ও স্ত্রী ফেলে উধাও হয়ে গেছে। মানুষ মরেনি। কিন্তু হাড্ডিসার হয়েছে, আধমরা হয়েছে, আত্মহত্যা করেছে।
করোনার আক্রমণ মন্থর হওয়ায় জীবিকার যুদ্ধ সজোরে চলছে। কেমন সজোরে?-তা বলবেন অর্থনীতিবিদরা। গ্রামের বাজারে এক রাজমিস্ত্রী সামান্য তরকারি বিক্রি করতে এনেছে। দেড় কেজির মত ঝিঙে, দুই কেজির মত বরকটি ও চারটে লেবু। অনেকদিন রাজমিস্ত্রীর কাজ নেই। তিন বাচ্চার সংসার। গ্রামে হাট বসে সপ্তায় ২ দিন। আগামী হাটে হয়তো কোন তরকারি বিক্রি করতে পারবেই না। আজকে যে তরকারি রাজমিস্ত্রির বউ ঘরের কাজের ফাঁকে পরিশ্রম করে উৎপাদন করেছে তার দাম দেড়শ টাকার বেশি হবে না। অর্থনীতিবিদরা শিল্পপতিদের হিসেব করেন। গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষগুলোর আয়ের হিসেব কে মেলাবে? করোনাকালে অর্থনীতির বাইরে যে ব্যাপারটা খামখেয়ালীভাবে পালিত হয়েছে তা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি। কেউ সরকারি নির্দেশ মত চলছে, কেউ মুখ ঢেকেছে-নাক খোলা। বারবার গণমাধ্যমে তাগাদা দেয়া, প্রদর্শন করা সত্ত্বেও সামাজিক দূরত্ব মানা ও মাস্ক ব্যবহারে অনীহা করোনার সামাজিক বিস্তারের অন্যতম কারণ।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব নিয়মে চলেছে। কেউ স্বাস্থ্যবিধি নিজ পরিবারে মানলেও প্রতিষ্ঠানে মানেনি। বহু আলেম স্বাস্থ্য বিধি মেনে নামাজ, এবাদত করেছেন তবে অনেকে ‘তাওয়াক্কুল’ এর নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন। আবার তারাই অসুস্থ হলে বড় ডাক্তার খুঁজেন। নিজের ‘তাওয়াক্কুল’ আছে অন্যদের নেই-একরম ভাবা কোন মুসলমানের কাজ নয়। অমুক মসজিদের ইমাম এরকম করছে- অতএব আমি তা করব না- এই ধরনের কাজও হয়েছে ব্যক্তিগত ‘হাছদ’ বা ঈর্ষাপরায়ণতার জন্য। আমাদের দেশে ইসলাম চর্চা এমনিতেই বিশ্ব ইসলাম থেকে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন। করোনায় যখন বিশ্ব-মুসলিমরা ‘এজমা কিয়াসের’ মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজ, হজ্ব, উমরা পালন করেছেন তখন আমাদের দেশের অনেক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব-বিশেষ করে ছোট অঞ্চলে এক ধরনের ধর্মীয় উগ্রতায় আচ্ছন্ন। একজন আলেম আমাকে বললেন- অমুক মসজিদে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজ পড়ছে-এটা কোন শরীয়তে আছে? আমি ভাবলাম হয়ত এই আলেম ঐ আলেমকে পছন্দ করেন না তাই এরকম বললেন। নতুবা বিশ্ব উম্মাহ এক ধরনের ঐকমত্য পোষণ করে স্বাস্থ্যবিধি পালন করছে আর আমাদের এখানে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা বিভক্ত। মানুষ বিভ্রান্ত।
করোনার সামাজিক আক্রান্ত অনেক ব্যাপক। অনেক দরিদ্র পরিবার মেয়ে পার করার জন্য প্রায় অপরিচিত ভিন্ন জেলার পাত্রকে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। বউ বাচ্চা বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বেমালুম চম্পট এসব জামাই। এটা নেহায়েৎ আর্থিক পরাজয়ের কারণে। করোনাকালীন অসুখে যত মরেছে-আত্মহত্যা, খুন এ কম মরেনি। কারণ অর্থনৈতিক, যার ফলে সামাজিক অবক্ষয়।
নতুন রোগ বলে নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য আসছে। কোটি টাকার ভ্যাকসিন ব্যবসা দিয়ে মুনাফা অর্জনও বিপাকে। কারণ এখন বলা হচ্ছে এইসব ভ্যাকসিন দীর্ঘ প্রতিরোধ দিবে কিনা বলা যাচ্ছে না যেমন সারাজীবনের প্রতিরোধ দেয় যক্ষ্মা জাতীয় ভ্যাকসিন। তাই অন্য দশ রোগের মতই এ রোগ থাকবে। ভাইরাস এর রূপ পরিবর্তন এ তীব্রতা যত হয়।
আম জনতা ও কিছু গোঁড়া ধর্মান্ধ করোনা চলে গেছে বলে মশকরা করলেও আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস এ ১ কোটি বাচ্চা এতিম হয়ে গেছে-এই বাস্তবতাও যেন স্মরণ করে। সাবধানের মার নেই। আপাতত একমাত্র সাবধানতা মাস্ক ও সামাজিক দূরত্ব ও জনসমাবেশপূর্ণ স্থানে ৫ থেকে ১৫ মিনিট এর মধ্যে অবস্থান সীমিত রাখা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক