ইউক্রেন যুদ্ধ : কেন?
ইউরোপে ৪৪টি স্বাধীন দেশ আছে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র আইসল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, বেলরুশ, মস্টিনিগ্রো ইত্যাদি থেকে শুরু করে বড় রাষ্ট্র জার্মানী, রাশিয়া, ফ্রান্সও আছে। মজার ব্যাপার হল ৩০-৪০ লক্ষ লোকের দেশ মেসেডোনিয়া বা বেলরুশ-প্রত্যেকটা জাতি নিজের জাতিসত্তা নিয়ে ভীষণভাবে গর্বিত। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ সমস্ত ইউরোপীয় যুদ্ধই সংগঠিত হয়েছিল জাতিগত বিরোধের কারণে। সাদা রং ইউরোপীয় জাতির ‘কমন কালার’ বটে। কিন্তু দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপে ব্যাপক নৃতাত্বিক মাইগ্রেশন হয়। বিভিন্ন ভাষী, বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীয় মানুষ আধুনিক রাষ্ট্রে মিশ্রিত হয়ে বাস করে। পশ্চিম ইউরোপে গণতন্ত্রের কারণে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে একদেশের মানুষ অন্য দেশে বসবাস, বিয়ে-শাদী, চাকরি করতে থাকে। বহু দেশে, নগরে জাতিগত বিন্যাস সৃষ্টি হয়। ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপ জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দেয় সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের ফলে। মহাপরাক্রমশালী যুগোশ্লাভিয়ার ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া ও বলকান ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর মাঝে ব্যাপক উগ্র জাতীয়তাবাদ শুরু হয়। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। আবার জর্জিয়া, চেচনিয়া, আবখাজিয়া প্রভৃতি প্রাক্তন রুশ অঞ্চলে জাতিগত দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়।
এসব সংঘাতের কারণ বুঝলে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ বুঝতে সহজ হবে ।
কমিউনিস্ট আমলে রুশ জাতি সত্তার লোকজন পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্যে ও রাষ্ট্রে গণহারে বসতি শুরু করে; জর্জিয়া, আবখাজিয়া, চেচনিয়া, ইউক্রেনসহ সমস্ত অঞ্চলে রুশজনগোষ্ঠী বসতি করে ফেলে। একইভাবে যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশনে সার্ব, ক্রোট জনগোষ্ঠী বসনিয়া, মেসিডোনিয়ায় মুসলিম অঞ্চলে বসতি করে। ১৯৮৯ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পুরো অঞ্চলে জাতিয়তাবাদ উগ্র জাতিয়তাবাদের রূপ নেয়। যার ফলশ্রুতিতে সাবিয়ানরা বসনিয়ায় গণহত্যা চালায়। জর্জিয়া, আবখাজিয়া, চেচনিয়া, আবমেনীয় সমস্ত অঞ্চলে রুশপন্থী আর জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে যুদ্ধে জনবল ও আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয় এতদসব অঞ্চলে।
ইউক্রেন রাষ্ট্রের দক্ষিণ ও পূর্বের ক্রিমিয়া, দোমেতস্ক, লুহানস্ক, মারিউপুল ও খারকিভ অঞ্চলে সেই ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর বিস্তর রুশভাষী লোক বসতি স্থাপন করে। সোভিয়েত পতনের পর ইউক্রোনীয়রা সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে। রুশভাষীরা মার্জিনা লাইজড মনে করে নিজেদেরকে। রাষ্ট্র পর্যায়ে ভোটাভুটিতে রুশ ভাষীরা একদিকে ভোট দেয়, জাতীয়তাবাদীরা অন্য দিকে ভোট দেয়। পুতিন সরকার বরাবর রুশ ভাষীদের সমর্থন দিতে থাকে। এখান থেকেই বিরোধ শুরু। সাভিয়েত পতনের পর ১৯৯৪ সালে ইউক্রেন সমস্ত আনবিক অস্ত্র রাশিয়ার কাছে এই শর্তে সমর্থন করে যে ইউক্রেনের উপর নিরাপত্তা জনিত হুমকি আসলে রাশিয়া তা প্রতিহত করবে। রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র বুদাপেস্টে Budapest Memorandum on security assurance চুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেনকে স্বাধীন রাজনৈতিক ভূমিকার নিশ্চয়তা দেয়। বর্তমানে ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার যুদ্ধ চরম বিশ্বাসঘাতকতারূপে দেখা যেতে পারে।
ঘটনার ক্রমঅবনতি হতে থাকে ইউক্রেনের রাজনীতিতে রাশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। রুশ বিরোধী বিক্ষোভের ফলে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রধানমন্ত্রীকে গোপনে রাশিয়া নিয়ে গেলে ইউক্রেনে স্থানীয় ও রুশ ভাষীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে রুশভাষী ক্রিমিয়া জোর করে দখলে নেয় রাশিয়া ২০১৪ সালে। ক্রিমিয়া দুই পক্ষের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, কৃষ্ণসাগর ও আজব সাগরের মধ্যবর্তী এটা গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও টুরিস্ট স্পষ্ট।
এই প্রেক্ষাপটে রক্ষক যখন ভক্ষক রূপে আবির্ভূত হল তখন ২০০৮ সালে বুখারেস্ট সামিট এ জর্জিয়া, ইউক্রেন ও রুমানিয়া ন্যাটোতো যোগ দেয়ার আবেদন করে। ন্যাটোর চার্টার অনুযায়ী ন্যাটোভুক্ত দেশেই ন্যাটো সৈন্য পাঠাতে পারে। রাশিয়াকে মোকাবেলায় ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীদের ন্যাটোর যোগদানের সিদ্ধান্ত রাশিয়াকে আরো ক্ষেপিয়ে তুলে।
রাশিয়া তার বলয়ে এই প্রথম যুদ্ধ করছে না। ১৯৫৬ সালে হাংগেরীতে রাশিয়া জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ চালায়। ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ায়ও রাশিয়া আক্রমণ চালায়।
বর্তমানে যে যুদ্ধ চলছে তাতে রাশিয়ার আগ্রাসন একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি অসম যুদ্ধ। মারিউপুলের রাশিয়ার অবরোধ ২য় বিশ্বযুদ্ধ কালীন লেনিনগ্রাদ যুদ্ধের মত। এখানে হিটলার বাহিনী ৮৮২ দিন অবারোধ করে রেখেছিল। ইউক্রেনের প্রতিটি শহরে এখন মানবিক বিপর্যয় চলছে। যার দায়মুক্তি রাশিয়া পাবে না। বলা হচ্ছে এটা এককভাবে পুতিনের যুদ্ধ; রাশিয়ানদের যুদ্ধ নয়।
ইউরোপের প্রতিটি দেশই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালীন সময় থেকে গেরিলা যুদ্ধে পটু। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দুই লাখ ইউক্রেনীয় স্বেচ্ছায় রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেশে পৌছে গেছে। এরাই এখন প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া পারমাণবিক যুদ্ধে গেলে তার প্রভাব শুধু ইউক্রেনে নয় বৃহৎ রাশিয়াতেও পড়বে। তাই সেটাও ঝুঁকিপূর্ণ। আফগানিস্তানের শোচনীয় পরাজয়ের স্মৃতি রাশিয়ান সৈন্যদের এখনো তাড়া করছে। তাই সৈন্যদেরকে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে ধরে রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক যুদ্ধ থেকেও জাতীয়তাবাদের যুদ্ধ তীব্র এবং আগ্রাসীরা টিকে থাকতে পারে না। এটাই ইতিহাস।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক, কলামিস্ট