ভূগোর গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:২৯ পূর্বাহ্ণ

অসাম্প্রদায়িক বাংলা : ফিরে দেখা

সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িক এ জাতীয় শব্দ ইদানীং সমাবেশ ও মিডিয়ায় অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও ইতিহাসের বিশেষ করে যুক্ত বাংলার ইতিহাসের বারংবার বিবর্জিত শব্দগুলোর নতুন আবির্ভাব ইতিহাসের নিদারুণ উপহাস। অবিভক্ত বাংলায় তুর্কী, আফগান, মোগল আমলে বর্তমানে যে সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় সে ধরনের কোন ঘটনার বিবরণ কোন সাহিত্য, উপকথায় বিবরণ পাওয়া যায় না। (নীতিশ সেনগুপ্ত: ২০১২) বরং ১২ থেকে ১৪ শতকের মুসলিম শাসকরা সংস্কৃতের প্যারালাল এক লোকজ সাহিত্যকে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন। এই ভাষা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে বাংলা ভাষার জাতিসত্তা রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় রূপ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মাধ্যমে।

বাংলাভাষী মানুষদের আরেকটি ঠিকানা পশ্চিম বাংলা অপর রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত। সমাজের অনেক উপষঙ্গকে জোর করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা দিতে গেলেও পশ্চিম বাংলাতেও চড়াইউৎরাইয়ের ইতিহসে বাংলাভাষাই একতা ও মর্যাদার প্রধানতম অনুষঙ্গরূপে বারেবারে ফিরে আসে।

বিগত একশ বছরে বাংলাভাষী মানুষদের সাম্প্রদায়িক চেতনায় জাতিসত্তার কখনো একত্রীকরণ, কখনো বিভাজন আজকের তরুণ প্রজন্ম উগ্রবাদী, প্রগতিবাদী সবার জন্য পিছনে ফিরে দেখা উচিৎ আমাদের পূর্বসূরীরা কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ভাবনায় সাম্প্রদায়িকতাকে পরাজিত করে ‘পজিটিভ’ রাজনীতি করেছিলেন। পৃথিবীর কোন জাতির ইতিহাসে একই মানুষ একবার বিভাজন, একবার একত্রীকরণ পুনরায় বিভাজনের শিকার হয়েছে। শুধুমাত্র সমসাময়িক সমাজের স্বার্থের দিকে না দিকে বুর্জোয়া নেতৃবৃন্দের স্বার্থচরিতার্থ করতেই যুক্তবাংলার ইতিহাসে এসব ঘটনা ঘটেছিল।

বাংলাভাষী মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে প্রথম বিশ্লেষণ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় বিষয় নয়। এটা কোন সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক অবদমনের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ।

১৯২৭ খ্রীস্টাব্দে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে যে রাজনৈতিক চুক্তি করেছিলেন তা হিন্দুমুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করে। বর্তমানে দিল্লীর নেতৃত্বের সাথে পশ্চিম বাংলার নেতৃত্বের যে টানা পোড়ন তাও ঐতিহাসিকভাবে ১০০ বছর পুরোনো। অন্ধ্রপ্রদেশের কাকিনাদ শহরে ১৯২৪ সালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস নেতৃত্ব চিত্তরঞ্জন দাশের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু বাংলার হিন্দু কংগ্রেসীরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ চালিয়ে যায়। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতা করে তারাই ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ যেটা ছিল মুসলিমদেরকে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর করার একটা কর্মসূচিসেটাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জির মত নেতা তরুণ বিধান চন্দ্র রায়ের কাছে পরাজিত হয়েছিল। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে পুরো বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা পরাজিত হয়। যুক্ত বাংলার দুর্ভাগ্য যে একই সময় সি.আর দাশের মৃত্যু হয় ও সুভাষ বসুকে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব ও মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক সাইড লাইনে ফেলে দেওয়া। তবুও দেশবন্ধু ও সুভাষ বসু তৎকালীন বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা কতটুকু ব্যাক ফুটে ফেলেছিলেন এবং জনগণ ও বুদ্ধিজীবীরা দুই সম্প্রদায়ের স্বার্থে কতটুকু নিবেদিত ছিলেন তা বোঝার জন্য আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মত একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তির একটা মন্তব্য উল্লেখ করতে হয়। আচার্য পিসি রায়কে ১৯৩২ সালে করাচী ইয়ং মুসলিমদের এক সম্মেলনে দাওয়াত করা হয়। তিনি দ্ব্যর্থ কন্ঠে বলেনসাধারণ হিন্দুমুসলিম জনগণের মধ্যে কোন বিরোধ নাই। সব বিরোধ উপরতলার বুদ্ধিজীবী ও নেতাদের। কত প্রাসঙ্গিক আজকের দুঃসময়ে আচার্য পিসি রায়ের উপলব্ধি।

যুক্ত বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনমত কত প্রবল ছিল এবং উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ কত প্রজ্ঞাশীল ছিল তার একটা অনন্য উদাহরণ শ্যামা হক মন্ত্রীসভা। এই সময়টা যুক্ত বাংলার জন্য সত্যিই রাজনৈতিক নেতৃত্বহীনতার সময়। নেই সিআর দাশ, নেই সুভাষ বসু, আবার একদিকে সুভাষ বসুর অনুগামী কংগ্রেস নেতাদের কংগ্রেস ত্যাগ, অন্যদিকে বাংলার কংগ্রেস নেতৃত্বের দিল্লীর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক অবজ্ঞা, আর এক দিকে মুসলিম লীগ কর্তৃক পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার সব মিলিয়ে বাংলার দুঃসময় কি রাজনৈতিকভাবে, কি সাম্প্রদায়িকতার প্রসারভাবে। এ. কে ফজলুল হক মুসলিম লীগ হাইকমান্ডের বিরোধীতায় জিন্নাহপন্থী নেতাদের সমর্থনের অভাবে বাংলায় সরকার গঠন করতে অপারগ ছিলেন। এমনি অবস্থায় হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীসহ হিন্দু কংগ্রেসের বড় নেতারা দিল্লীর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ফজলুল হককে সরকার গঠনে এগিয়ে আসেন। এটাই ঐতিহাসিক শ্যামা হক মন্ত্রীসভা নামে খ্যাত। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নির্দেশনা উপেক্ষা করে যুক্ত বাংলার হিন্দুমুসলিম নেতারা সাম্প্রদায়িকতাকে পরাজিত করতে সেদিন যে পদক্ষেপ নিয়েছিল আজকের পরিস্থিতিতে আমাদের সবার তার থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি। শ্যামা হক মন্ত্রীসভায় চারজন বড় হিন্দু নেতা ছিলেন। হিন্দু মহাসভার শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এসোসিয়েট প্রেস অফ ইনডিয়া (এপিআই) শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর দীর্ঘ সাক্ষাতকার নেন। তাকে প্রশ্ন করা হয় তিনি কেন ফজলুল হক সরকারে যোগ দিয়েছেন? উত্তরে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী বলেছিলেনদেশ ও সামাজিক সম্প্রীতির স্বার্থে যে হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হতে পারে বাংলার নেতারা ভারতকে তা দেখিয়েছেন। আমাদের মধ্যে বিভেদের পয়েন্ট থেকে ঐক্যের পয়েন্ট বেশি, (নীতিশ সেনগুপ্ত ২০১২)। শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী হক সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি প্রথম বাজেটে এক লক্ষ রুপী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেন। শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি ঢাকার করোনেশন পার্কে (পুরান ঢাকায়রাজা ৫ম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে নির্মিত) এক বক্তৃতায় বলেনহিন্দু মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলায়ে দেশ গঠন করবে। হিন্দুরা মসজিদ পাহারা দিবে, মুসলিমরা মন্দির পাহারা দিবে। সারা ভারতকে বাংলার হিন্দুমুসলিম দেখাবে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হয়। শ্যামাহক মন্ত্রীসভায় সুভাষ বসুর ভাই শরদ বসুকে ফজলুল হক অন্তর্ভুক্ত করায় দিল্লীর গান্ধী নেহেরুজিন্নাহ বৃটিশদের কানভারী করে। ফলে শরদ বসু মন্ত্রী হওয়ার কয়েকদিন পরেই পদত্যাগ করেন। বাংলায় শ্যামাহক মন্ত্রীসভা বেশ জনপ্রিয় হলেও বৃটিশরা তাদের কাজে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে। বৃটিশরা শ্যামাহককে পাস কাটিয়ে আমলা দিয়ে কাজ চালাতে থাকে। ফলে শ্যামা প্রসাদ ও ফজলুল হক দুই বাঘা ব্যক্তিত্বের সাথে বৃটিশ আমলাদের দ্বন্দ্ব প্রকট হয় ও ওই সরকারের পতন হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িকতার পতন ঘটে। সুযোগ সন্ধানীরাকংগ্রেস ও জিন্নাহ বাংলা ভাগ করে নেয়। ১৯০৫ সালে যারা বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে ছিল তারাই ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ করে। এটা বাংলাভাষী মানুষের ইতিহাসে এক বিরাট ‘প্যারাডকস’।আজকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উপমহাদেশ এক অসুস্থ রাজনীতির শিকার। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অনিশ্চিত মৌলিক অধিকার এসব প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ভাষায় এটা সত্যিই বড়লোকদের মধ্যে ঘৃণা। সাধারণ নাগরিক এখনো সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। ঊনিশ শতকের বাংলার সে সব নেতা আর আসবে না। কিন্তু তাদের জীবন, রাজনীতি চর্চা ও অসাম্প্রদায়িকতার দিকে ফিরে দেখা জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোবাইল আর ফাস্ট ফুড অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধজ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে