ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সরকার সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। জালিয়াতি, প্রতারণা ও অসত্য তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে যাঁরা সরকারি ভাতা নিয়েছেন, তাঁদের সেই ভাতা সুদে–আসলে ফেরত নেওয়া সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। প্রতারণার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা যাঁরা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, তাঁদের সংখ্যা এখন পর্যন্ত আট হাজার বলে জানা গেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আজ রোববার থেকে সব জেলা প্রশাসককে (ডিসি) চিঠি দেওয়া হবে। এসব ব্যক্তির কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা ফেরত নিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা রাখা হবে। এ বিষয়ে ‘সরকারি পাওনা আদায় আইন, ১৯১৩’ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ১২ জুন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে সরকারি ভাতা সুদে–আসলে ফেরত নেওয়ার পরামর্শ, সুপারিশ ও সিদ্ধান্ত এসেছে। রোববার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর শুরু হবে। তিনি বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করা ৮ হাজার ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদ’ আমরা বাতিল করেছি। এখন আমরা প্রত্যেকের জন্য একটি করে ফাইল খুলব। কে কত টাকা নিয়েছেন সেটি খুঁজে বের করব।
একই সঙ্গে কার সুপারিশে তারা (জালিয়াত) মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন– সেটিও অনুসন্ধান করা হবে বলে জানান মন্ত্রী মোজাম্মেল হক। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে দেশে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৩৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ২০ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দিচ্ছে সরকার। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষ্যে ১০ হাজার করে দুটি বোনাস, বিজয় দিবসে ৫ হাজার টাকা এবং বাংলা নববর্ষের ২ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন তারা। খেতাবপ্রাপ্ত, শহিদ ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ১১ হাজার ৯৯৮ জন। তারা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা বছরে সরকার থেকে ভাতা পান প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এ বিষয়ে মন্ত্রীর স্পষ্ট বার্তা, যারা জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে সরকারি টাকা (যে ভাতা নিয়েছেন) আদায় করে ছাড়ব।
সরকার ২০১৩–২০১৪ অর্থবছর দেশের কোথাও কোনো মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে থেকে গেছেন কিনা– তা নিশ্চিত করতে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। তখন বাদপড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অনলাইনে আবেদন আহ্বান করা হয়। ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর আবেদন গ্রহণ করা হয়। ওই সময় করা আবেদনগুলো ক, খ ও গ তালিকা নাম দিয়ে ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি যাচাই–বাছাই কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
এক্ষেত্রে বিধান করা হয়, উপজেলা পর্যায়ে যাচাই–বাছাইয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আবেদনকারীকে শনাক্ত করবেন। যদি সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা এই মর্মে সাক্ষ্য দেন যে, আবেদনকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা, তাহলে তার আবেদন ক–তালিকাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। জামুকার সুপারিশসহ মন্ত্রণালয় গেলে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই–বাছাইয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে কমিটির সদস্যদের। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার ভিড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করা খুব কঠিন। শুধু আট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনাক্ত হয়েছে তা নয়, অনেক স্থানে নতুন তালিকাতেও আবার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুকছে টাকার বিনিময়ে। এ নিয়ে সারাদেশেই কমিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে।
সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা মোশতাক আহমেদ তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ‘জানি, মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির বিষয়টি সহজ নয়। এ জন্য অনেক প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। প্রশ্নটা সেখানেই। একজন ব্যক্তি যখন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করেন, তখন তাতে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অনেককেই সুপারিশ করতে হয়। অনেক ঘাট পেরিয়ে সবশেষে জামুকার সভায় তাঁকে অনুমোদিত হতে হয়। প্রশ্ন হলো, একজন অমুক্তিযোদ্ধা কেমন করে এতগুলো ঘাট ম্যানেজ করে? তাহলে কি ধরেই নেওয়া যায়, সরিষার মধ্যেই ভূত রয়েছে? আর সেই ভূতগ্রস্ত সরিষার সুযোগ নিচ্ছে অসৎ ও স্বার্থান্বেষী চক্র?’
যেসব ব্যক্তি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাটা প্রশংসাযোগ্য। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রকৃত সম্মান জানানো হবে। তালিকায় আরো যদি ভুয়া হিসেবে আগামীতে সনাক্ত করা যায়, তাতে জাতি উপকৃত হবে।