মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক বলেছেন, সরকারি ও আধা–সরকারি প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কতজনের চাকরি হয়েছে, এর একটি তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘বিগত আন্দোলনে প্রধান বক্তব্য ছিল মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা। তাই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কতজনের চাকরি হয়েছে, সেটার একটি তালিকা প্রস্তুত হওয়ার পর পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরা সবার সামনে উপস্থাপন করব। মুক্তিযুদ্ধ না করে যারা মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
১৫ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা বলেন, ‘যাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি হয়েছে, তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কি না, ন্যায্যভাবে হয়েছে কি না–বিষয়টি জাতির সামনে উপস্থাপন করব। এ বিষয়ে কাজ হচ্ছে। সেখানে বহুবিধ মামলা রয়েছে। সেখানে ৩ হাজার ৭০০–এর মতো মামলা পেন্ডিং (ঝুলন্ত) আছে, রিট করা আছে– সেই মামলাগুলো অ্যাড্রেস করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার মাঝখানে একটা প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় রয়েছে, সেটা হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল জামুকা। কারা মুক্তিযোদ্ধা হবে না হবে–সেটা জামুকা নির্ধারণ করে দিত। মন্ত্রণালয় শুধু তাদের নির্ধারিত হওয়া বিষয়টি বাস্তবায়নে যেত। এটার আইনগত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া বহু জায়গা থেকে অভিযোগ আসছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও আপত্তি আছে। এসব বিষয়ে আমরা যখন একটা পর্যায়ে যাব, তখন আপনাদের ডেকে জাতিকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’
মুক্তিযোদ্ধা রিভিউ (পর্যালোচনা) হবে কি না, এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘অবশ্যই হবে, যেন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সম্মানটা ফিরে পায়। মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের জাতীয় জীবনে অনন্য ঘটনা। আমরা হাসি–মশকরা বা অবহেলা দিয়ে নষ্ট করতে পারি না। এ রকম গৌরবোজ্জ্বল ও ত্যাগের বীরত্বের মহিমা জাতির কাছে তো আর আসেনি। যারা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা, তারা ওটাই ফিরে পেতে চান। এটাই তাঁদের ফিরে পাওয়ার আকুতি।’
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন এবং বলেন, এটা তো জাতির সঙ্গে প্রতারণা। এটা তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা, তারা এ বিষয়টি নিয়ে অপমানিত বোধ করছেন।’
প্রতারণার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা যাঁরা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, তাঁদের সংখ্যা এখন পর্যন্ত আট হাজার বলে জানা গেছে। ইতোপূর্বে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, তৎকালীন সরকার ২০১৩–২০১৪ অর্থবছর দেশের কোথাও কোনো মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে থেকে গেছেন কিনা– তা নিশ্চিত করতে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। তখন বাদপড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অনলাইনে আবেদন আহ্বান করা হয়। ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর আবেদন গ্রহণ করা হয়। ওই সময় করা আবেদনগুলো ক, খ ও গ তালিকা নাম দিয়ে ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি যাচাই–বাছাই কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
এক্ষেত্রে বিধান করা হয়, উপজেলা পর্যায়ে যাচাই–বাছাইয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আবেদনকারীকে শনাক্ত করবেন। যদি সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা এই মর্মে সাক্ষ্য দেন যে, আবেদনকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা, তাহলে তার আবেদন ক–তালিকাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। জামুকার সুপারিশসহ মন্ত্রণালয় গেলে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই–বাছাইয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে কমিটির সদস্যদের। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার ভিড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করা খুব কঠিন। শুধু আট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত হয়েছে তা নয়, অনেক স্থানে নতুন তালিকাতেও আবার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুকছে টাকার বিনিময়ে। এ নিয়ে সারাদেশেই কমিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে।
সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা মোশতাক আহমেদ তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ‘জানি, মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির বিষয়টি সহজ নয়। এ জন্য অনেক প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। প্রশ্নটা সেখানেই। একজন ব্যক্তি যখন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করেন, তখন তাতে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অনেককেই সুপারিশ করতে হয়। অনেক ঘাট পেরিয়ে সবশেষে জামুকার সভায় তাঁকে অনুমোদিত হতে হয়। প্রশ্ন হলো, একজন অমুক্তিযোদ্ধা কেমন করে এতগুলো ঘাট ম্যানেজ করে? তাহলে কি ধরেই নেওয়া যায়, সরিষার মধ্যেই ভূত রয়েছে? আর সেই ভূতগ্রস্ত সরিষার সুযোগ নিচ্ছে অসৎ ও স্বার্থান্বেষী চক্র?’
যেসব ব্যক্তি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রকৃত সম্মান জানানো হবে। তালিকায় যদি ভুয়াদের সনাক্ত করা যায় এবং বিচারের আওতায় আনা যায়, তাহলে জাতি উপকৃত হবে।