ভিক্ষাবৃত্তি মানুষকে অকর্মণ্য বানাতে সাহায্য করে

এমিলি মজুমদার | শনিবার , ১৮ জুন, ২০২২ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ভিক্ষাবৃত্তি হচ্ছে পুঁজিহীন ব্যবসা, স্থান কাল পাত্র এসব কিছু বিবেচনায় আনার প্রয়োজন নেই, শুধু হাত পাতলেই হলো। আর আমরাও হয়েছি ওই রকম, অফিসে যাতে দিনটা ভালো কাটে, তার জন্য দাও ভিক্ষা, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের জন্য ভিক্ষা, অসুস্থের সুস্থতা কামনা করে ভিক্ষা, চাকরী পাওয়ার জন্য ভিক্ষা, কিছু হলেই পকেট থেকে ৫-১০ টাকা নোট টপ্‌ করে ভিক্ষুকের হাতে পড়ে। এই অভ্যাসের কারণেই আজ আমাদের দেশেএত ভিক্ষুক। ইতিহাসের আদি থেকেই মানব সমাজে ভিক্ষুকেরা বিদ্যমান থাকলেও বর্তমানে উন্নতদেশগুলোতে ভিক্ষুকের সংখ্যা নগণ্য। আগে আমাদের দেশ উন্নত দেশগুলোর কাছে মিসকিন অর্থাৎ ভিক্ষুক হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বিশ্ব দরবারে আমাদের সে বদনাম ঘুচেছে, আর যাই বলুক আমাদের দেশকে এখন আর কেউ ভিক্ষুক হিসেবে জানে না। আমাদের দেশ অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে বিশ্ব দরবারে। বিশ্বে আমাদের এই বদনাম ঘুচলেও আমাদের দেশে ভিক্ষুকের অভাব নেই, কারণ অভাবে নয়, এদের বেশী সংখ্যক স্বভাবেই এই পেশা বেছে নিয়েছে।

সত্যি বলতে কি হাত পাতা আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে, ঘুষ গ্রহণও কিন্তু হাত পেতে নেয়া। ভিখারীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত বলে এদের ঘুরে ঘুরে হাত পাততে হয় না, টেবিলে বসেই বেশীরভাগ কাজ সারে। কেউ রাস্তায় ছুটন্ত গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাত পেতে ২০-৫০ নিয়ে পকেটে গুঁজেই তৃপ্ত, কাউকে ফাইলের ভেতর করে খয়রাত অটো চালান করতে হয়, কেউ কেউ আবার মাধ্যম জোগাড় করে নেন ভিক্ষা গ্রহণের জন্য। আগে কিছু কিছু নির্দিষ্ট পেশা ছিল যাদের পরিচিতি ছিল ঘুষখোর। বর্তমানে অবস্থার উন্নতি হয়েছে, ঘুষ নেয়া হয় না এমন পেশা খুঁজে পাওয়া ভার। যেখানে কোনো সুযোগ নেই, সেখানেও শুনতে হয়, ‘চা-পানি খাওয়ার জন্য কিছু দিয়ে যান, স্যার’, হাত পেতে যদি চা-পানির ব্যবস্থা করা যায় মন্দ কি! সত্যিই চরম দুর্ভাগ্য আমাদের। ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ।

দেশে ঘুষখোরদের পাশাপাশি রাস্তায় রাস্তায় ভিখারীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ভোর পাঁচটায়ও যদি মর্নিং ওয়াকে বের হই দেখা যাবে দলে দলে ভিক্ষুক, শপিং-এ গেলে ভিক্ষুক, হোটেলের বাইরে ভিক্ষুক, বাজার, মার্কেট, বাস স্টপেজ, রেল স্টেশন, সমুদ্রের পার, অফিস, মসজিদ, ট্রাফিক সিগন্যাল, আদালত পাড়া মোটামুটি হাঁটতে চলতে পদে পদে ভিক্ষুকের দেখা মিলবেই। মাঝে মাঝে হাত, জামাকাপড় খামচে ধরে অপ্রস্তুত করে তোলে। এ ছাড়া বেশকিছু ধনীর বাড়ির সামনে সুন্দর করে সাজানো থাকে এক শ্রেণীর লোক প্রতিনিয়ত, যা তাদের বাড়ির শোভা বর্ধন করে। মসজিদ আর মাজারের সামনের কথা না-ই বা বললাম! ক’দিন আগে তিন বিদেশী অতিথিকে নিয়ে মিমি সুপার মার্কেটে যাই কিছু শপিং করাতে। ঢুকতেই ৭-৮ জন ৫-১২ বছর বয়সী ছেলেমেয়ে এসে ওদের হাত ধরে টাকা দেয়ার জন্য টানাটানি শুরু করে। শপিং মলের ভেতর এহেন ঘটনায় আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি, মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে কোনো ভাবে ওদের সরিয়ে দেই, দৌঁড়ে পালিয়ে যায় ছেলেমেয়েগুলো। আমার প্রাণপ্রিয় চট্টগ্রামে ঘর থেকে বের হলেই যে দুটো বিষয় দৃষ্টি ও মেজাজ পীড়িত করে, তার একটা হচ্ছে ভিক্ষুক, অন্যটা ডাস্টবিন বিহীন আমার শহর অর্থাৎ পুরো শহরটাই ডাস্টবিন! এত নোংরা কিভাবে কারো নজরে পড়ে না বুঝি না। এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। কর্তৃপক্ষের চোখ থেকেও অন্ধ। সারা রাস্তা জুড়ে শুধু স্তুপকৃত ময়লা। দিনের বেলা ময়লা তোলার কাজে নিয়োজিত গাড়িগুলো যেদিক দিয়ে যায়, সেদিকেই প্রকট দুর্গন্ধ ছড়ায়। দুদিন আগে, বিকেল ৩ঃ৪৫, আমি লাঞ্চ সেরে হেঁটে অফিস যাচ্ছি, নাসিরাবাদ এক নাম্বার রোডে ঢুকতেই নজরে এলো বিশাল ময়লা তোলার সিটিকর্পোরেশনের গাড়ি। প্রতি এ্যাপার্টমেন্টের সামনে থেমে থেমে ময়লা উঠাচ্ছে। আমি নাক কাপড় দিয়ে চেপে ধরেও থাকতে পারছিলাম না। গাড়ির নীচ দিয়ে ঝর্নার মত ঝড় ঝড় করে পচা ময়লার জল পড়ছিল রাস্তায়। আমি বোঝাতে পারবোনা সে অসহনীয় অবস্থার কথা। দিনের বেলা ময়লা তোলার কাজ সম্ভবত আমাদের দেশ ছাড়া আর কোথাও হয় না!

যাই হোক ভিক্ষুকের কথায় ফিরে আসি
ভিক্ষাবৃত্তি বৃদ্ধির প্রথম কারণ হচ্ছে লজ্জাহীনতা, হাত পাতা যে চরম লজ্জার এই ন্যূনতম বোধ নেই বলেই হাত পাততে তাদের লজ্জা করে না। প্রকৃত শিক্ষার অভাব এর অন্যতম কারণ।এরা মনে করে ভিক্ষা পাওয়া তাদের ন্যায্য অধিকার। আবার এমনও অনেক আছেন যারা ভাবেন ভিক্ষুককে পাঁচ টাকা দিলে উপরওয়ালা তাদের দশ টাকা কিংবা আরো বেশী দেবেন! এমনও অনেকে আছেন যারা তরকারীওয়ালা রিক্সাওয়ালা ইত্যাদি যারা খেটে খাচ্ছে তাদের পাঁচ দশটাকা কম দেয়ার জন্য রীতিমত বচসা বাধিয়ে দেয়, কিন্তু অনায়াসে সামর্থবান ভিক্ষুকের হাতে তার চাইতে বেশী টাকা দান করেন, আমি এর কোনো মানে বুঝি না। আমাদের ভিক্ষুকদের ৮০-৯০ শতাংশ ভিক্ষুকের কাজ করার সামর্থ্য রয়েছে, তবে তারা কাজ না করে ভিক্ষা করে। এদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ালে বিধাতা সন্তুষ্ট হওয়া তো দূরের কথা, বরং উল্টো অসন্তুষ্ট হবেন বলেই আমার বিশ্বাস। যে মানুষ ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতে পারে সে কোনোভাবেই অচল নয়। কাজ করে খাওয়ায় যে আনন্দ, যে সম্মান সে বোধটুকু এদের নেই। অন্যান্য দেশে খুব কম ভিক্ষুক দেখতে পাওয়া যায়, শারীরিক দিক থেকে অক্ষম মানুষরাও যে যার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করে খায়। হাত পাতাটা তাদের কাছে খুব অসম্মানের।

আমার মত আরো অনেকের মতে কর্মক্ষম মানুষকে ভিক্ষা দেওয়া মানে এই পেশায় তাদের অনুপ্রাণিত করা। আমাদের দেশে যাকাত হিসেবে বেশ মোটা অংকের টাকা দান করা হয়। ২০-৫০-১০০ টাকা করে দান না করে, এই দানের টাকা একত্রিত করে যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী বণ্টন করা যায় অথবা অক্ষমদের পুনর্বাসন, সক্ষমদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে কিন্তু ভিক্ষুকের সংখ্যা কমিয়ে আনা কোনো ব্যাপার না। প্রথমেই আমাদের ভিক্ষা দেয়ার প্রবণতা বর্জন করতে হবে। সক্ষম লোক হাত পাতাটা যতটা দোষের, তাদের হাতে আমরা যারা কিছু ফেলি, তারাও ঠিক ততটাই দোষী, কারণ আমরা তাকে অকর্মণ্য বানাতে সাহায্য করছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধসময় গেলে সাধন হবে না
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে