ভাস্কর নভেরা আহমেদ একটি নাম, একটি ইতিহাস। কালের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া একটি নাম। নিভৃতে নীরবে চলে গেলেন নভেরা আহমেদ। যিনি ভাষা শহীদদের অমর গাথা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা করে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে মার্চ ১৯৩৯ এ নভেরার জন্ম। বাবা সৈয়দ আহমেদ কর্মসূত্রে সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাস করতেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রামের আসকার দিঘীর উত্তর পাড়ে। গবেষকদের মতে তাঁর পিতার মূল নিবাস চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। বাবার চাকরির সুবাদে নভেরার শৈশব কেটেছে কলকাতায়। সেখানে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে নাচ, গান এর পাশাপাশি মডেলিং করা ছিল তাঁর শখ। কলকাতার লরেটা হতে তিনি প্রবেশিকা (ম্যাট্রিক) পাস করেন। ১৯৪৭ এ ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত বিভাগের পর নভেরার পরিবার পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) এর কুমিল্লায় চলে আসেন। সেখানে নভেরা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫০ এর দিকে নভেরার পিতা সৈয়দ আহমদ চাকরি হতে অবসর নেন এবং তাঁরা কুমিল্লা হতে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম চলে আসেন। এসময়ে নভেরা পুনরায় চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫০ এর শেষের দিকে আইন বিষয়ে পড়ার জন্য তিনি লন্ডনে চলে যান। শৈশব হতে নভেরার ইচ্ছা ছিল ভাস্কর্য বিষয়ে পড়াশুনা করা, তাই তিনি লন্ডনে সিটি এন্ড গিল্ডস্টোন কাভিং ক্লাসে যোগ দেন। ১৯৫১ তে তিনি ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস এন্ড ক্রাফটসে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইনের মডেলিং ও স্কাল্পচার কোর্সে ভর্তি হন। সেখানে পাঁচ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করার পর ১৯৫৫তে ইতালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে ভাস্কর্য বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৫৪ এর জানুয়ারি মাসে নভেরা ও হামিদুর রহমান একসাথে ফ্লোরেন্সে যান। শিক্ষা জীবন শেষে ১৯৫৬ এর জুন মাসে নভেরা দেশে ফিরে আসেন। সে সময়ে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ চলছিল। ভাস্কর হামিদুর রহমানের সাথে নভেরা আহমেদ শহীদ মিনারের প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু করেন।
১৯৫৮ এর দিকে দেশে সামরিক আইনজারী হলে তাঁদের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আমি এখানে সংক্ষিপ্তকারে শহীদ মিনার নির্মাণের পূর্ব কিছু ইতিহাস উল্লেখ করতে চাই। ১৯৫৭ এ পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতউর রহমান শহীদ মিনারের পরিকল্পনা প্রণয়ন করার অনুরোধ করেন প্রধান প্রকৌশলী জব্বার এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে। জব্বার সাহেবের অন্যতম সহকর্মী ছিলেন প্রকৌশলী শফিকুল হক।
বিখ্যাত লেখক রবিউল হুসাইন ‘ভাস্কর্যে মুক্তিযুদ্ধ’ নামক শিরোনামে প্রবন্ধে লিখেন, ‘আমাদের দেশে স্থাপত্য ভাস্কর্যের সুন্দরতম উদাহরণ হলো শিল্পী হামিদুর রহমান ও ভাস্কর নভেরা আহমেদ এবং স্থপতি জাঁ দেলোরা কর্তৃক নকশাকৃত ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’। শিল্পী হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ কর্তৃক শহীদ মিনারের যে মডেল ও স্কেচ উপস্থাপন করেন তা সরকারের সে সময়কার স্থাপত্য বিষয়ক উপদেষ্টা জাঁ দেলোরা তার স্তম্ভগুলোর ‘মা’ কিছুটা পরিবর্তন করেন। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কলমের টানে সংকলনে লিখেন, ‘হামিদুর রহমান ও ভাস্কর নভেরা আহমেদ ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পরিকল্পনাকারী শিল্পী’। যদিওবা অনেকের কাছে শহীদ মিনারের পরিকল্পনাকারী হিসেবে নভেরা আহমেদ এর নাম অজ্ঞাত থেকে যায়। নভেরার কাজের প্রধান দিক হলো নারীদের প্রতিমূর্তি। সমসাময়িক পুরুষ শিল্পীরা ইউরোপীয় ইন্দ্রিয় সুখাবহ নারীদের একটি রোমান্টিক ইমেজ দেবার চেষ্টা করেন। এমনকি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল সহ অনেকে নারীকে মাতা, কন্যা, স্ত্রী আর অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখালেও নারীদের যথার্থ কর্মময় জীবন উপেক্ষিত থেকে যায়। নভেরা নারীকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে পুরুষ শিল্পীদের উপস্থাপনার বিপরীতে তুলে ধরেছেন। নভেরার কাজের পর্যালোচনা করতে গিয়ে বৃটেনের সমালোচক ম্যারি মারশাল নভেরার দি লং ওয়েট কাজটি সম্পর্কে বলেন, ‘এটি অত্যন্ত চমৎকার ও অদ্ভুত উদাহরণ, যেখানে হতাশায় পিছিয়ে পড়া নারী মুক্তি পথ খুঁজছে দৃঢ়তার সাথে’।
নভেরার বহুমাত্রিক কাজের বর্ণনা দিতে গেলে ছোট পরিসরে তা সম্ভব নয়। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী নভেরা আহমেদকে নিয়ে আমাদের দেেেশ তেমন লেখালেখি না হাওয়ার কারণে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকেছেন।
১৯৬০ এর ৭ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় গণ–গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতির উদ্যোগে এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় নভেরার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়। সে প্রদর্শনীর ভাস্কর্যের কিছু অংশ সংগ্রহ করে ১৯৯৮ সালে আরেকটি প্রদর্শনী বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের উদ্যোগে প্রদর্শিত হয়।
নভেরার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী হয় ১৯৭০–এ ব্যাংককে। ১৯৭৩ এর জুলাই মাসে প্যারিসে রিভগেন গ্যালারিতে তৃতীয় একক প্রদর্শনী হয়। এরপর ১৯৮৮ এ প্যারিসে, ২০১৪ এর ১৬ জানুয়ারি প্যারিসে রিভগেসে নভেরা আহমেদ এর রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনী শিল্পকর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় একশ দিনব্যাপী অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি হতে ২৬ এপ্রিল ২০১৪ পর্যন্ত চলে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ভাস্কর হিসেবে নিজের একটা দৃঢ় অবস্থান তৈরী করতে সমর্থ হয়েছিলেন নভেরা।
নভেরা আহমদ তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশে ও বিদেশে বহুলভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। দেশে তাঁর কাজের স্বীকৃত স্বরূপ ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ২১শে পদকে ভূষিত করেছেন, এছাড়া ১৯৬১ এ ভাস্কর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিং স্কাল্পচার এন্ড গ্রাফিক আর্টস শিরোনামে এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া তার ছ’টি ভাস্কর্যের মধ্যে চাইল্ড ফিলোসফার নামে একটি ভাস্কর্য বেস্ট স্কাল্পচারে পুরস্কৃত হয়।
এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ হল’। দীর্ঘ সময়কাল প্যারিসে অবস্থানকালীন কোন এক অজ্ঞাত কারণে ও অভিমানে তিনি দেশের সাথে সম্পর্ক রাখেন নি। এক কথায় দেশের মানুষের স্মৃতির আড়ালে অজ্ঞাতবাসেই ছিলেন শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়নকারী গুণী এ শিল্পী। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের গর্ব, বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের অন্যতম অগ্রদূত এবং প্রথম বাংলাদেশী আধুনিক ভাস্কর্যবিদ, নারী অধিকারের অন্যতম রূপকার আধুনিক মন ও মননশীলতার প্রতীক নভেরা আহমেদ ৪৫ বছর ধরে দেশের বাইরে থাকলেও ৫ মে ২০১৫ হতে একেবারেই চলে গেলেন। ৫ মে ২০১৫ মঙ্গলবার প্যারিস ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা চট্টগ্রামের মানুষ তার কর্মের স্বীকৃতি ও যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি এবং তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
তথ্য সূত্র : ১। হাসনাত আবদুল হাই লিখিত উপন্যাস ‘নভেরা’, ২। ওয়েবসাইট, ৩। দৈনিক প্রথম আলো ০৭ মে ২০১৫সহ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধাদি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক– শিল্পশৈলী