চট্টগ্রাম হয়ে ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা গতকাল বহুল আলোচিত ভাসানচরে পৌঁছেছে। নৌবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর সাতটি জাহাজে করে তাদের সেখানে পাঠানো হয়। এর আগে চট্টগ্রামের অস্থায়ী ক্যাম্পে তাদের হাতে ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেয়া হয়। কঙবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের ক্যাম্প ছেড়ে ভাসানচরের পরিকল্পিত আবাসন পেয়ে খুশি রোহিঙ্গারা। সবকিছু মিলিয়ে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় ভাসানচর নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশন মিলিয়ে গুচ্ছ গ্রামের আদলে গড়ে তোলা ভাসানচর আশ্রয়ন প্রকল্পের নতুন বাসিন্দাদের যার যার ঘরে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল রোহিঙ্গা মাঝিদের। তারা নিজের দলের সদস্যদের খুঁজে নিয়ে যার যার ঘরে তুলে দেন। যে যার পরিবারের লোকজন, ব্যাগ-পোটলা হাতে নিয়ে সন্তানকে কাঁধে তুলে এমনভাবে নতুন বানানো ঘরগুলোর দিকে ছুটলেন, যেন তাদের অনেকদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটল। একটি দলের মাঝি জানান, ‘আমরা অনেক আশা নিয়ে এসেছি। আমরা খুব খুশি।’ আর ভাসান চর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের বললেন, ‘প্রতীক্ষার অবসান হল। রোহিঙ্গাদের প্রথম দল এখানে আসায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। এখানে আজ একটা উৎসবের দিন।’
বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গতকাল খুব সকালে যাত্রা করার কথা থাকলেও নদীতে কুয়াশা এবং অস্থায়ী ক্যাম্পে কিছু আনুষ্ঠানিকতার জন্য জাহাজ ছাড়া হয় সাড়ে ১০টায়। এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ৩৯টি বাসে করে উখিয়া কলেজের মাঠ থেকে রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম নিয়ে আসা হয়। পতেঙ্গা বিএএফ শাহীন কলেজ মাঠ ও বোট ক্লাব এবং এর আশপাশের এলাকায় অস্থায়ী ট্রানজিট শিবিরে তাদের রাখা হয়েছিল। গতকাল সকালে বোট ক্লাব, কোস্ট গার্ড এবং নৌবাহিনীর রেডি রেসপন্স বার্থ থেকে জাহাজগুলো যাত্রা করে। এই সময় রোহিঙ্গ নারী পুরুষদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, তারা স্বেচ্ছায় ভাসান চর যাচ্ছেন। তাদের একটি দল গত ৫ সেপ্টেম্বর চরটি ঘুরে এসে তাদের কাছে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কথা তুলে ধরেন। প্রতিনিধি দলটি তাদেরকে চরের গুচ্ছ গ্রামের বাড়ি ঘরের ছবি দেখিয়েছে। ইন্টারনেটেও তারা ভাসান চরের ছবি দেখেছে। তাদের মনে হয়েছে ক্যাম্পের গিঞ্জি পরিবেশ থেকে নতুন এই আবাসন অনেক ভালো। তাই তারা তাদের নতুন জীবন ওখানেই শুরু করতে চায়। ভাসান চর মুখে যাত্রা করা একাধিক রোহিঙ্গা নারী পুরুষ টেলিফোনে মায়ানমারের সামরিক বাহিনির অবর্ণনীয় নির্যাতনের বর্ননা দিয়ে বলেন, কোনোদিন নিজের ভূমিতে ফিরতে পারবো কিনা জানি না। তবে ভাসান চরে পরিবার পরিজন নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করবো। প্রসঙ্গক্রমে তারা বলেন, ‘আমাদের অনেকের আত্মীয় স্বজনভাসান চরে রয়েছে। জীবনে তাদের সাথে আর দেখা হবে না মনে করেছিলাম। অথচ তাদের সাথে দেখা হবে। এটি ভাবতেই ভালো লাগছে।’ উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন আগে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধারকরে আগেই ভাসানচরে নিয়ে রাখা হয়েছিল। গতকাল তাদের বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন ভাসান চর পৌঁছেন। কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, রোহিঙ্গারা বেশ খুশি মনেই ভাসান চর যাচ্ছে। তাদের কারো মনে বিন্দুমাত্র সংশয় এবং শংকা দেখা যায়নি। শিশু কিশোর এবং নারী পুরুষ মিলে রোহিঙ্গার এই দলটি দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ভাসান চরে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসতি হবে বলেও তারা জানান। সরকারের পাশাপাশি ২২টি এনজিও সংস্থা রোহিঙ্গাদের ভাসানচর স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় কাজ করছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে ১০লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফের উখিয়ায় আশ্রয় নেয়। উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস। যাদের মধ্যে লাখ খানেক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হচ্ছে।
১৩ হাজার একর আয়তনের ভাসান চরে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৮ সালে গৃহীত প্রকল্পটির আওতায় ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি ঘর তৈরি করা হয়েছে। এখানে ১লাখ ১ হাজার ৩৬০ শরণার্থী বসবাস করার মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।
দেড় হাজারের মতো একতলা ভবনের পাশাপাশি ১২০টি বহুতল ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো দুর্যোগের সময় সাইক্লোন শেল্টার হিসেবেও ব্যবহৃত হবে। বসবাসের জন্য পরিকল্পিত আবাসনের পাশাপাশি স্কুল, খেলারমাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সোলার পাওয়ার ও জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রান্নার জন্য সিলিন্ডার গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থাও থাকবে। রোহিঙ্গাদের আয় রোজগারের জন্য বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতরের খামারের কাজ, হাতের কাজ ছাড়াও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকবে। চরে আবাদ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। পরীক্ষামূলকভাবে ধানচাষও করা হয়েছে বলেও কোস্ট গার্ডের একজন কর্মকর্তা জানান। তিনি বলেন, কঙবাজার অঞ্চলের ক্যাম্পের চেয়ে ভাসান চরে অনেক বেশী স্বাচ্ছন্দে থাকবে রোহিঙ্গারা। গতকাল একাধিক রোহিঙ্গা তাদের জীবনযাত্রায় ভাসানচর নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, কুতুপালং কঙবাজার ক্যাম্প থেকে চাপ কমানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার আমাদের ভাসানচর নিয়ে যাচ্ছে। ভাসানচরের পরিবেশ সুন্দর উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন এখানে আমাদের থাকা খাওয়া বিনামূল্যে বলে জানানো হয়েছে। আবদুল হাকিম বলেন এখানে ভালো লাগছে, শান্তি লাগছে। কুতুপালং ক্যাম্পে জ্যাম আর গরম বেশি।
সুরু জামান বলেন, আমরা ভাসানচরে থাকতে যাচ্ছি। ঘর বাড়ি দিবে বলছে। চাষাবাদের ব্যবস্থা থাকায় আমরা এখানে আসছি।
ভাসান চর আশ্রয়ন প্রকল্প পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী চৌধুরী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের গতকালই তাদেরকে স্বস্ব ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহ এখানকার রোহিঙ্গাদের রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে।