বহুল আলোচিত ভাসানচরে পৌঁছে বেশ আনন্দিত ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা। উখিয়া এবং টেকনাফের ক্যাম্প ছেড়ে ভাসানচরের পরিকল্পিত আবাসন পেয়ে খুশি তাঁরা। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় এই ভাসানচর নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। ‘ভাসানচর পৌঁছে খুশি ওরা’ শীর্ষক ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩ হাজার একর আয়তনের ভাসান চরে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৮ সালে গৃহীত প্রকল্পটির আওতায় ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি ঘর তৈরি করা হয়েছে। এখানে ১লাখ ১ হাজার ৩৬০ শরণার্থী বসবাস করার মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।
দেড় হাজারের মতো একতলা ভবনের পাশাপাশি ১২০টি বহুতল ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো দুর্যোগের সময় সাইক্লোন শেল্টার হিসেবেও ব্যবহৃত হবে। বসবাসের জন্য পরিকল্পিত আবাসনের পাশাপাশি স্কুল, খেলারমাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সোলার পাওয়ার ও জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রান্নার জন্য সিলিন্ডার গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থাও থাকবে। রোহিঙ্গাদের আয় রোজগারের জন্য বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতরের খামারের কাজ, হাতের কাজ ছাড়াও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকবে। চরে আবাদ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। পরীক্ষামূলকভাবে ধানচাষও করা হয়েছে বলেও কোস্ট গার্ডের একজন কর্মকর্তা জানান। তিনি বলেন, কঙবাজার অঞ্চলের ক্যাম্পের চেয়ে ভাসান চরে অনেক বেশী স্বাচ্ছন্দে থাকবে রোহিঙ্গারা। একাধিক রোহিঙ্গা তাদের জীবনযাত্রায় ভাসানচর নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। মিয়ানমার সরকার তাদের ওপর নির্যাতন ও গণহত্যা চালিয়ে বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে দেশত্যাগে বাধ্য করে। উদ্বাস্তুর তকমা লাগিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে কঙবাজারের কটি এলাকায়। বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে তাদের সে সময় আশ্রয় দেয়। এখনো তারা সেখানেই বসবাস করছে। বাংলাদেশ তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। তারা সেখানে যেভাবে বসবাস করছে তাকে যন্ত্রণাদায়ক বলা যেতে পারে। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যেই সরকার ভাসানচরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমন্বয়ে গড়ে তুলেছে একটি পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবন বদলে দেওয়ার সব আয়োজন রয়েছে এই ভাসানচরে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএইচসিআর) স্ট্যান্ডার্ড সেখানে এমন সব সুযোগ-সুবিধা মেনে তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পিত আবাসন। রোহিঙ্গদের জন্য সেখানে এমন সব সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে, যা দেশের নাগরিকদের বড় একটি অংশ এখনো পায় না।
ভাসানচর আবাসন প্রকল্পের পরিচালক নৌবাহিনীর কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী পত্রিকান্তরে বলেন, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পরিকল্পিতভাবে এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নির্মাণ কাঠামো করা হয়েছে। মানসম্মত জীবনধারণের সব আয়োজন রয়েছে এখানে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিতে সব ধরনের ত্রুটি এড়িয়ে কাজটি করার চেষ্টা করেছি।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, ভাসানচরে স্থানান্তরের পর এখন জীবন সম্পর্কে ধারণাই পাল্টে যাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। উন্নত আবাসন, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, পর্যাপ্ত সুপেয় পানি, পরিবেশসম্মত সেনিটেশন সুবিধা, জীবিকানির্বাহের সুযোগ, খাদ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা তাদের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এর পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা তাদের জীবনকে সহজ করবে, চিন্তার জগৎকে সমপ্রসারিত করবে।
ভাসানচরে স্থানান্তরের পর এখন রোহিঙ্গাদের জীবনধারণ, সেটাও কিন্তু স্থায়ী সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধান হলো রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা পড়ে থাকবে, তা হতে পারে না। মিয়ানমারকে তাদের ফেরত নিতে হবে অবশ্যই। বিশ্বনেতৃবৃন্দকে দৃষ্টি দিতে হবে এদিকে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে যত ধরনের টালবাহানা করুক, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। বিশ্ব জনমত ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। সেই জনমতের প্রতি মিয়ানমারকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ যেন আরো বৃদ্ধি পায়, তার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকে।