চট্টগ্রামের সন্তান চৌধুরী হারুনুর রশিদ যিনি ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এক নাগাড়ে চার বছর জেল খেটেছিলেন। তিনিই সর্বাধিক সময় কারাবন্দী ছিলেন চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম ভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। একুশের শহীদদের স্মরণে প্রথম শোক গাথা রচনা কারী কবি মাহবুবউল আলম চৌধুরী তার বন্ধু। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’’ কবিতাটি পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোহিনূর প্রেস ম্যানেজারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সব কপি নিয়ে যায়। মাহবুবউল আলম চৌধুরী আত্মগোপনে চলে যান। ২২ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে চট্টগ্রামের ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত সভার নিষিদ্ধ কবিতা পাঠ করার দায়িত্ব পড়ে চৌধুরী হারুনের উপর। অকুতোভয়ে তাঁর জলদ গম্ভীর কন্ঠে হাজারো জনতার সামনে এই কবিতা তিনি পাঠ করেন তৎকালীন জেলা পুলিশ প্রধানের কার্যালয় সংলগ্ন মাঠে পুলিশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। সেখান থেকে চলে যেতে পারলেও পুলিশের গোয়েন্দারা অনুসরণ করে সেই রাতেই তাকে গ্রেপ্তার করে। তখনও তিনি মুসলিম লীগের তরুণ নেতা। জেলার যুগ্ম সম্পাদক। কিন্তু দ্বি-জাতিতত্ত্বের অন্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তিনি কোন দিন মনে প্রাণে গ্রহণ করেননি। ফলে একেবারে প্রথম দিনেই থেকে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ধাপ ভাষা আন্দেলনের ছিলেন অকুতোভয় প্রথম কাতারের সৈনিক। দীর্ঘ ৪ বছরের জেল জীবনে তার রাজনীতিক ধ্যান ধারণায় আমুল পরিবর্তন আসে। জেলে তিনি শুধু অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে ঋদ্ধ হননি। তিনি সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার একনিষ্ঠ সাধক হয়ে উঠেন। তৎকালীন জেল বন্দী কমিউনিষ্ট নেতাদের বিশেষত তাঁর জন্ম স্থান পটিয়ার কমিউনিস্ট নেতা শরদিন্দু দস্তিদারের সাহচর্যে তিনি পুরোদস্তুর সমাজন্ত্রের লড়াকু সৈনিকে পরিণত হন। উৎপাদনের প্রধান শক্তি শ্রমিক কৃষকের বিপ্লবী রাজনৈতিক মন্ত্রে দীক্ষিত হন। দীর্ঘ ৪ বছর এক নাগাড়ে জেল খেটে ১৯৫৬ সালে মুক্ত হয়ে তার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রেলওয়ে একাউন্টস্ লাগের নির্বাচনে অবাঙালি শ্রমিক নেতা চেরাগ খানকে পরাজিত করে তিনি একাউন্টস লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই থেকে আমৃত্যু তিনি রেল শ্রমিকদের সংগঠনে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর তিনি ‘বাংলাদেশ রেল শ্রমিক ইউনিয়নের’ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ক্রমান্বয়ে তিনি ব্যাংক এমপ্লয়ীজ ফেডারেশন, সিজেএমমিএল. লি: (কালুর ঘাট জুট মিল) ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। একইভাবে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান শ্রমিক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারী করলে চট্টগ্রামের বহু প্রগতিশীল কমিউনিস্ট নেতার উপর গ্রেপ্তারি পারওয়ানা (হুলিয়া) জারী করে। তিনি তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। সাথে প্রকাশ্য বাম রাজনৈতিক সংগঠন ন্যাপেরও নেতা। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনকালে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পার্টির নিদের্শে সংগঠন আন্দোলন গড়ার স্বার্থে তিনি হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে যান। আয়ুব খান জীবত/মৃত যে কোন অবস্থায় গ্রেপ্তার করার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। শুধু চৌধুরী হারুন নয় ন্যাপ কমিউনিষ্ট পার্টির বহু নেতার উপর এই হুলিয়া জারী করা হয়। চট্টগ্রামের অধ্যাপক আসহার উদ্দিন, কৃষক নেতা আবদুস সত্তার, শ্রমিক নেতা আসহান উল্লাহ চৌধুরীর উপর গ্রেপ্তারী পারওয়ানা জারী হয়। কমিউনিস্ট নেতা অমর সেন, অমত্ত সেন, পূর্ণেন্দু কানুনগো, বীরেন দাশ প্রমুখ জেল থেকে বের হয়ে হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপন করেন। সার্বিক শাষণ বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন।
অনেক রাজনৈতিক সমীকরণ শেষে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের লড়াইয়ের প্রধান দল আওয়ামী লীগের সাথে কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগসহ আরও কয়েকটি ছোট ছাত্র সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ফলে ৬৯ সালে গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এই দীর্ঘ আন্দোলনও গণ অভ্যুথানে চৌধুরী হারুন আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক চৌধুরী হারুন ত্রিপুরার আগরতলায় ন্যাপ সি.পি.বি. ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেবিলা যোদ্ধাদের যুগ্ম কমান্ডারে দায়িত্ব পালন করেন। চৌধুরী হারুন ও মোঃ ফরহাদ এই বাহিনীর তেজপুর ও স্থানীয় ভাবে ট্রেনিং প্রাপ্ত ১৯০০০ গেরিলা যোদ্ধা মুক্তি বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন অনেকে শহীদ হয়েছেন।
চৌধুরী হারুন ছিলেন অত্যন্ত সুবক্তা। তাঁর জনচিত্ত মোহীনি বক্তব্য শোনার জন্য মানুষ অপেক্ষা করতেন। এই বক্তৃতার সময় মাঠে পিনপতন নীরবতা হয়ে বিরাজ করতো। অথচ তিনি শুধু বক্তা ছিলেন না অত্যন্ত ক্ষুরধার অথচ যুক্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণী বক্তব্য দিতেন তিনি। সুরুচিপূর্ণ সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হিসাবেও চৌধুরী হারুন ছিলেন সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি একজন গেজেটের মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু তার স্ত্রী বা মেয়ে কেউ তাঁর মুক্তিযুদ্ধের ভাতা গ্রহণ করেন না।
১৯৮৬ সালে তিনি সংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন পটিয়া থেকে আসনে ১৫ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসাবে। তিনি দেশের প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বিগত অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে লড়াই করে যাচ্ছে চৌধুরী হারুনের আদর্শকে পাথেয় করে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র,
চট্টগ্রাম ও সদস্য, চট্টগ্রাম শ্রম আদালত