ভাষা আন্দোলন এবং আমাদের অর্জন

সৌভিক চৌধুরী | মঙ্গলবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এর সূচনা হলেও ক্রমে এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। ভাষা আন্দোলন আমাদের প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন, যার সূত্রপাত ১৯৪৮ সালেই হয়েছিল। আন্দোলনের প্রথম পর্বটি শুরু হয়েছিলো তখন থেকেই আর দ্বিতীয় পর্ব ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সাফল্য লাভ করে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ বিভাগের সময় ভাষাতাত্বিক দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বালুচী এবং পূর্ব পাকিস্তান বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তৎকালীন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪% বাংলা, ২৫.০৪% সিন্ধি ৭.% উর্দু ৭.%, পশতু,পাঞ্জাবী ৫.% এবং বাকি অন্যান্য ভাষাভাষী লোক। এ থেকে বোঝা যায় উর্দু ছিলো পাকিস্তানী ভাষাভাষীর দিক থেকে ৩য় স্থানে। অন্যদিকে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার ৪.৪০ কোটির মধ্যে ৪.১৩ কোটিই ছিল বাংলা ভাষাভাষী। এখানে ৯৮% বাংলা এবং মাত্র ১.% ছিলো উর্দু ভাষী। অথচ বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পনা নেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর অনুভূতিকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত অনুভব করেনি পাক শাসকগোষ্ঠী। মূলত পূর্ববঙ্গে কখনোই উর্দু ভাষার চর্চা হয়নি। বাঙালিরা গণতন্ত্র, জনসংখ্যাধিক্য ইত্যাদি কারণে ৫৬% বাংলাভাষীদের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবী করেছে। এর সাথে জড়িত ছিলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ।

ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ প্রেক্ষাপটটি শুরু হওয়ার সূচনা লগ্নে ১৯৪৭ সালে অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিশ। এর উদ্যোগে ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের সভায় প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়েছিলো। তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ এক সফল গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়।বাংলা ভাষার দাবীতে এইভাবেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা ঘটে। প্রবল প্রতিবাদের ফলে তৎকালীন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সংগে ১৫ মার্চ চুক্তি করতে বাধ্য হন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস পরিষদের দলের নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। গণপরিষদে তিনি যে প্রস্তাবটি আনেন সেটি প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। তাঁর এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ব্যাপক বিক্ষোভে সালাম, বরকত, জব্বার সহ অনেক ছাত্র জনতা শহীদ হলে ভাষার দাবীতে আন্দোলন এক নতুন মাত্রায় চলে যায় এবং এই গণহত্যার ফলাফল দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল চট্টগ্রামে। বাংলা সাহিত্যের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদের স্মরণে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামের সাহিত্য সংকলন প্রকাশিত হয়। তারও আগে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গণহত্যার পর প্রথম কবিতা রচনা করেন কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী। একুশ আমাদের সাহিত্য ভাবনাকে যেভাবে তাড়িত করেছে অন্য কিছু তা করতে পারেনি। একুশের রক্তাক্ত স্মৃতি আমাদের কবিতায় তাৎক্ষণিক এবং সুন্দর প্রতিফলন ও অনুপ্রেরণার সঞ্চার করেছে। একুশের ঘটনা ঘটেছিল ঢাকায় অথচ চট্টগ্রামে সেদিনই রচিত হয়েছিল কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর ১৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী দীর্ঘ কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’। কবিতাটি দ্রুত রচিত হয়েছিলো এবং আন্দরকিল্লার কোহিনুর ইলেক্টিক প্রেসে মুদ্রিত হয়ে ১৯৫২র ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদিঘি ময়দানের বিশাল জনসভায় চৌধুরী হারুনুর রশিদ কর্তৃক পঠিত হয়েছিলো। কবিতাটি এতটাই বার্তাবহ ছিলো যে শাসকগোষ্ঠী ভীত হয়ে তা বাজেয়াপ্ত করে। কবিতার রচয়িতা, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, প্রকাশক কামালউদ্দিন আহমেদ বি,এ র বিরুদ্ধে জারী করা হয়েছিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। চৌধুরী হারুন এবং প্রেস ম্যানেজার দবির আহমেদ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হলেও হুলিয়া মাথায় নিয়ে কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী হয়েছিলেন নিরুদ্দেশ। কবিতাটি আমাদের সাহিত্যে বিশেষ অবদান নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমাদের সংগ্রামী ইতিহাসকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে এই কবিতা।

৫২র ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলাদেশে নয়, এ আন্দোলন সারা পৃথিবীতে এখন সর্বজনজ্ঞাত। পৃথিবীর কোথাও ভাষার জন্য এত লোক শহীদ হয়েছে বলে জানা নেই। আমরা একুশ পালন করছি ‘ শহীদ দিবস‘ হিসেবে। দিবসটিকে আরও বিশেষ মর্যাদায় পালন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর মাধ্যমে, যেখানে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন হয়। ভাষা আন্দোলন আমাদের শিল্প সংস্কৃতিকে সুদৃঢ় ভিত্তিভূমিতে দাঁড় করিয়েছে। শিল্পকলার ক্ষেত্রে যদি বলি, ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলনে মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, ইমদাদ হোসেন, কাইয়ুম চৌধুরীর মত শিল্পীরা অংশগ্রহণ করে আন্দোলনকে এগিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের শিল্পকলাকে এগিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের শিল্প চর্চায় ভাষা আন্দোলন যেমন প্রভাব ফেলেছে তেমনি চিত্রকলায় নবসৃষ্টির ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। তরুণ চিত্রশিল্পীরাও ভাষা আন্দোলনের ভাবনাকে ধারণ করে এগিয়ে গেছে অনেকখানি। সাহিত্য, সংগীত এবং সুকুমার বৃত্তির ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর ৫০’র দশক ছিল রেনেসাঁ। এ সময়টাতে সংস্কৃতির ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছিল যা মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এগিয়ে যায় আর এর পরের দশকগুলোতেও সাংস্কৃতিক বলয়ে এই সংগ্রাম প্রতিফলিত হয়েছে।

৫২ র ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়েও প্রতিভাত হয়েছিল, যার ফলে ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন, ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভুত্থান এবং সর্বোপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীন বাংলাদেশ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই শিল্প সাহিত্যের নতুন দুয়ার খুলে গিয়ে সাহিত্যিকদের সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনার ক্ষেত্র অনেকদূর এগিয়ে যায়। নিজস্ব ভাষা প্রতিষ্ঠার অধিকার সকলের মাঝেই বিরাজ করে, বাঙালি সংস্কৃতির দীপ্যমান ধারা একুশের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে যুগ পরম্পরায়। একুশের চেতনার তাৎপর্য বহুমুখী। বাঙালি।র জাতীয় চেতনাকে একুশ দিয়েছে প্রগতির নির্দেশনা। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা বাঙালির উপর যে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়ন চালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনায় সংগঠিত একুশ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন এবং প্রাণিত করেছে। একুশের চেতনা ক্রমেই পরিণতি লাভ করেছিল স্বাধীনতার চেতনায়। একুশের চেতনার অনন্য ফসল আজকের বাংলা একডেমি। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই বাংলা ভাষায় সাহিত্য ু সংস্কৃতির চর্চা, গবেষণা, এবং বিকাশে আমাদের নিজস্ব একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এটি। অনেক বছর ধরে আয়োজন করে চলেছে বই মেলা, যা আমাদের জ্ঞান এবং মননকে সমৃদ্ধ করছে। মূলত একুশ আমাদের অহংকার, আমাদের প্রেরণার উৎস। একুশের অবিনাশী চেতনা আমাদের এগিয়ে যাবার পথকে উজ্জীবিত করে। তাই এই চেতনাকে অম্লান রেখে আমাদের কল্যাণ এবং অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে হবে, জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বিস্তার ঘটাতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, আবৃত্তিশিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিন্দুক
পরবর্তী নিবন্ধবিপিসিকে আরো স্বচ্ছ ও গতিশীল করা এখন সময়ের দাবি