ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম ও একুশের প্রথম কবিতা

মুহাম্মদ শামসুল হক | বৃহস্পতিবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

কোনো জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবোধের উন্মেষ রুখে দিতে হলে তার মনের ভাব সহজে প্রকাশ করার উপায়টা বন্ধ করতে হয়। মানুষের মনের ভাব প্রকাশ পায় তার মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানিরা বাঙালির জাতীয়তাবোধের উন্মেষের পথ রুদ্ধ করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের অংশ হিসেবে ভাষার ওপর আঘাত হানার মাধ্যমে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথ বন্ধ করার অপচেষ্টা চালায়। সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের ভাষা উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করা হয় ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে। সেখানে কথা বলার সুযোগ রাখা হয় কেবল উর্দু এবং ইংরেজিতে। কিন্তু কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উদর্ এবং ইংরেজির সাথে বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষারূপে সরকারি স্বীকৃতির দাবি তোলেন। তাঁর এ দাবির বিরোধিতা করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ও গণপরিষদের সহসভাপতি মৌলবি তমিজউদ্দিন খান প্রমুখ। ফলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব ২৫ ফেব্রুয়ারি বাতিল হয়ে যায়। পরদিন ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালিত হয়। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। প্রগতিশীল ছাত্রনেতারা বাংলা ভাষার দাবিতে সারা দেশে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন এবং গণপরিষদে বাঙালি মুসলিম সদস্যদের নীরব ভূমিকার নিন্দা জানান।
ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগ নেতাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠনে সামিল হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস। এই সময় তারা যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের মাধ্যমে জেলা পর্যায় থেকে আন্দোলন সংগঠনের উদ্যোগ নেয়। ১৯৪৮ সালের ২৮ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা উপকমিটির এক সভায় বাংলাকে অবিলম্বে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবি জানানো হয়। ওই সভায় গণপরিষদের সরকারি ভাষা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া, পাকিস্তানের মূদ্রা ও ডাক টিকিটে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করা এবং নৌবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সভার পরদিন ১ মার্চ তমুদ্দুন মজলিশের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেম, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, নঈমুদ্দিন আহমদ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনের পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তাঁরা ১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘট সম্পূর্ণ সফল করার লক্ষ্যে প্রস্তুত হওয়ার জন্য দেশপ্রেমিক গণনেতা, ছাত্র ও যুবকর্মীর প্রতি আহ্বান জানান।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে চট্টগ্রামবাসীর ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ভাষার দাবিতে সূচিত আন্দোলনের ঢেউও গড়িয়ে আসে চট্টগ্রামে। ৪৮ সালের ১২ মার্চ প্রকাশিত পাকিস্তানের মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার করার ব্যাপারে কোনো উল্লেখ না থাকার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রগতিশীল চিন্তার নেতা-কর্মীরা এক গোপন সভায় মিলিত হন। এতে রফিকউদ্দিন সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক এবং কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও রেল শ্রমিক নেতা মাহবুবুল হককে যুগ্ম আহ্বায়ক করে মূলনীতি বিরোধী সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির উদ্যোগে লালদিঘির মাঠে জনসভা অনুষ্ঠান শেষে তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য এ কে খান ও নূর আহমদ চেয়ারম্যানের বাড়ি ঘেরাও করে এই মর্মে অঙ্গিকার আদায় করা হয় যে, মূলনীতিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসন ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়ে ব্যর্থ হলে তাঁরা গণপরিষদ সদস্যপদ ত্যাগ করবেন। অন্যদিকে ৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় উর্দূই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে ঘোষণা দেন তার প্রতিবাদেও লালদিঘির মাঠে জনসভার আয়োজন করা হয়। তবে মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা সভার প্রচারে বাধা দেয়, লালদিঘির সভা পণ্ড করে দেয়। ভাষার দাবিতে এটা ছিল প্রথম পর্যায়ের আন্দোলন এবং এতে যুক্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন চৌধুরী হারুন অর রশিদ, এটিএম শামসুদ্দিন, গোপাল বিশ্বাস, কালাচাঁদ, সুচরিত চৌধুরী, ডা. ছৈয়দুর রহমান, শহীদ সাবের আহমদ, এম এন এম নুরুন্নবী, মাহবুব হাসান, ডা. আজিম। জ্যেষ্ঠদের মধ্যে ভূমিকা রাখেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ আজিজ প্রমুখ। তমুদ্দিন মজলিশের পক্ষ থেকেও একাধিক বৈঠকে বাংলা ভাষার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরা হয়। সংগঠনের পক্ষে কাজ করেন আজিজুর রহমান, এজহারুল হক, সাদেক নবী, মো. মহসীন প্রমুখ। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের উল্লেখযোগ্য অংশও রাষ্ট্রভাষার পক্ষে আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন।
৪৮ এর মার্চের পর ভাষার দাবিতে আন্দোলন নানা কারণে স্তিমিত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন যখন আবার ঘোষণা করেন ‘উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ এর প্রতিবাদে ঢাকার সঙ্গে সমন্বয় করে চট্টগ্রামেও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সমন্বয় পরিষদ গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, যুগ্ম-আহ্বায়ক চৌধুরী হারুন অর রশিদ ও এম এ আজিজ। আওয়ামী লীগ (তখন আওয়ামী মুসলিম লীগ), তমুদ্দুন মজলিশসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি পরিষদে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পরিষদের নেতাদের মধ্যে আরও ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, শেখ মোজাফ্‌ফর আহমদ, ডা. আনোয়ার হোসেন, আজিজুর রহমান (গোরা আজিজ), আজিজুর রহমান (তমুদ্দুন মজলিশের), মুসলেম উদ্দিন, মফিজুল ইসলাম, নুরুজ্জামান, কুষ্ণগোপাল সেন গুপ্ত, শামসুদ্দিন আহমদ, রুহুল আমিন নিজামী, শুধাংশু ভাট্টাচার্য, সুনীল মহাজন, এমদাদুল ইসলাম, ডা. ছৈয়দুর রহমান, আবু জাফর, ডা. সরোজ বড়ুয়া, নুরুল আজিম, আমির হোসেন দোভাষ, এজহারুল হক প্রমুখ। সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো আন্দরকিল্লাস্থ তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়কে।
ঢাকার কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে চট্টগ্রামেও ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, মিছিল ও লালদিঘির মাঠে জনসভার আয়োজন করা হয়। কর্মসুচি সফল করার জন্য দুদিন আগে থেকে আয়োজকেরা পাড়া-মহল্লার ক্লাব ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মাঝে ব্যাপক সাংগঠনিক ও প্রচারকাজ চালান। এ পর্যায়ে মাহবুব উল আলম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়লে ২০ ফেব্রুয়ারি ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক হন চৌধুরী হারুন অর রশিদ। ২১ তারিখের হরতালে বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন এবং মিছিলে যোগ দেন। শহরের অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট সকাল থেকে বন্ধ ছিল। বিকেলে খবর আসে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে বহু হতাহত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামে লালদিঘির জনসভার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মিছিলকারী ছাত্র-জনতা চরম উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এবং ‘খুনীদের বিচার চাই-রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ‘জুলুমবাজি চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে লালদিঘির মাঠে সমবেত হন। শেখ মোজাফ্‌ফর আহমদের সভাপতিত্বে সভায় প্রায় ৪০ হাজার জনসমাগম হয় বলে ধারণা করা হয়। সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়।
চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ফসল মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কালজয়ী লেখা একুশের প্রথম প্রতিবাদী কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ ২০ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক জ্বর ও জলবসন্তে আক্রান্ত মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকায় গুলিবর্ষণের খবর শুনে অসুস্থ অবস্থায়ই তিনি প্রতিবাদী কবিতাটি লিখেন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদিঘির মাঠে রফিক উদ্দিন সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে জনসভায় কবিতাটি আবৃত্তি করেন চৌধুরী হারুন অর রশিদ। এ সময় মঞ্চে অন্যদের মধ্যে আবদুল হক দোভাষ ও নূর আহমদ চেয়ারম্যান (গণপরিষদ সদস্য) উপস্থিত ছিলেন। শিল্পপতি একে খান এবং ফজলুল কাদের চৌধুরীও সভায় যোগ দেন তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে। তবে তাঁরা কৌশলে জনতাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। শ্রোতারা কবিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘চল চল ঢাকা চল’, ‘খুনি লীগ শাহীর পতন চাই’, ‘নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকলে এ কে খান কবিতা পাঠ বন্ধ করার আদেশ দেন। কিন্তু আদেশ উপেক্ষা করে সাহসের সঙ্গে কবিতা পাঠ শেষ করেন চৌধুরী হারুন। ২১ তারিখ ছাড়াও ২২, ২৩ ও ২৪ তারিখও চট্টগ্রামে হরতাল ও মিটিৎ-মিছিল অব্যাহত থাকে।
প্রসঙ্গত পুলিশি তল্লাশি অভিযানকে ফাঁকি দিয়ে কবিতাটি আগের রাতে ছাপা হয় আন্দরকিল্লা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে। কবিতাটি পাঠ করার জন্য পুলিশ চৌধুরী হারুনকে ২৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া প্রেস কর্মচারী মো. দবিরকে গ্রেপ্তার করে প্রেসে তালা মেরে দেওয়া হয়। পরে দবিরকে দেওয়া হয় ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। মাহবুব উল আলম চৌধুরী আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা হয় হুলিয়া। চৌধুরী হারুনকে পরে রাজশাহী জেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
চট্টগ্রাম শহর ছাড়াও জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায়ও বিশেষত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হরতাল পালিত হয় এবং বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে রূপ দানের ক্ষেত্রে মাহবুব উল আলমের কবিতা এবং চট্টগ্রামবাসীর ভূমিকা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
-পিআইডি ফিচার
লেখক : সম্পাদক- ইতিহাসের খসড়া, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা সৈনিক আহমেদুর রহমান আজমী
পরবর্তী নিবন্ধপরীমনিকে সাবধান হতে বললেন হিরো আলম