বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁরা জীবন ও কর্মের মাধ্যমে দেশ গড়ার পথে অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক অঙ্গনে তাঁর কর্মকাণ্ডের ছাপ রেখে গেছেন। আজও তাঁকে চিরঞ্জীব মানুষ হিসেবে স্মরণ করা হয়, বিশেষত চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাউজান এলাকায়, যেখানে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা। উল্লেখ্য যে, তিনি রাউজানের ১১নং পশ্চিম গুজরা ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৫২ সাল থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত তিনি দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল এক রকমের নৈতিকতা, সততা এবং দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন একজন সৎ, ত্যাগী, আদর্শবান, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা, যিনি কখনোই ক্ষমতার জন্য নয়, বরং দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে জনগণ পেয়েছে এক ধরনের প্রেরণা এবং তাঁর জীবনাদর্শ এখনো নতুন প্রজন্মের কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
এক নিবেদিতপ্রাণ নেতার পরিচয় : এ.কে ফজলুল হক ১৯৩২ সালের ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান, অকুতোভয় জনপ্রতিনিধি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিত সংগঠক। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন–শোষণ প্রশ্নে সচেতন হয়ে ওঠেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি তীব্রভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যার অবদান দেশের ইতিহাসে চিরকাল অমর থাকবে। তাঁর মতো মানুষদের কথা স্মরণ করা হলে, যে দেশটি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিল, সেই দেশের স্বপ্ন পূরণের জন্য কতটা ত্যাগের প্রয়োজন ছিল তা উপলব্ধি করা যায়।
এ.কে ফজলুল হক ছিলেন একটি আদর্শের প্রতিনিধি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল একটি শিক্ষামূলক ইতিহাস, যেখানে তিনি শিখিয়েছিলেন কীভাবে সৎভাবে কাজ করতে হয়, কীভাবে একনিষ্ঠভাবে জনগণের জন্য কাজ করতে হয়। তাঁর এই মহান আদর্শের জন্যই তিনি আজও মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন। তাঁর প্রতি জনগণের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা আজও অটুট, কারণ তিনি কখনোই নিজের স্বার্থে কাজ করেননি। বরং তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল দেশের জন্য নিবেদিত, সাধারণ মানুষের কল্যাণে। ১৯৮৭ সালের ৭ জানুয়ারি নিজগৃহে এই মহান দেশপ্রেমিক ও জনদরদী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা : ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত এ.কে ফজলুল হক দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সংগ্রাম ছিল দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার এবং এ ক্ষেত্রে ভাষার অধিকার ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তাঁর ভূমিকা ছিল অনবদ্য। এ.কে ফজলুল হক ছিলেন একজন আদর্শ নেতা, যিনি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।
তাঁর মানবিকতা ও জাতীয় জীবনে অবদান : এ.কে ফজলুল হক ছিলেন অসামপ্রদায়িক ব্যক্তি। তিনি কখনোই ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণীর ভিত্তিতে মানুষকে আলাদা করেননি। তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশের সাধারণ মানুষকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের উন্নতি সাধনের জন্য প্রয়োজন সবার সমান অধিকার এবং সুযোগ। তাঁর এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে একটি স্বয়ংসিদ্ধ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তিনি এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। মানুষ তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন। তাঁর ত্যাগ, সততা, এবং দেশপ্রেমের জন্য মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করতো। তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল শুধু তাঁর রাজনীতির জন্য নয়, বরং তাঁর অসামপ্রদায়িক মনোভাব এবং জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসার জন্য। এমন মানুষ সত্যিই বিরল, যারা কেবল নিজেদের জন্য নয়, বরং জাতির কল্যাণের জন্য কাজ করেন।
একজন পরীক্ষিত নেতা : এ.কে ফজলুল হক ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পরীক্ষিত নেতা। তিনি তাঁর জীবনের প্রায় সব সময় কাটিয়েছেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। তাঁর সৎ, নিষ্ঠাবান এবং আদর্শবান রাজনীতি আজকের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর জীবন ছিল এক প্রকারের শিক্ষা, যেখান থেকে রাজনীতির শিক্ষার্থীরা শিখতে পারে কীভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে, সততার সঙ্গে রাজনীতি করা যায়। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ নেতার প্রতীক, যিনি কখনোই দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কাজ করেননি। বরং তাঁর সব কাজ ছিল জাতির কল্যাণের জন্য। তাঁর কাজের মধ্যে ছিল শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের প্রসার এবং দেশের জনগণের জন্য ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা।
ফজলুল হকের জীবনের শিক্ষা : এ.কে ফজলুল হকের জীবন এবং কর্ম থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি যে ধরনের সততা, দেশপ্রেম এবং আদর্শের প্রতীক ছিলেন, তা আমাদের সকলের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। তাঁর মতো মানুষদের স্মরণে এনে আমরা নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম, সততা এবং মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পারি। তিনি ছিলেন একজন অনন্য সাধারণ ব্যক্তি, যাঁর জীবন অশেষ ত্যাগ, সংগ্রাম এবং দেশপ্রেমের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। এ.কে ফজলুল হকের জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে, রাজনীতি বা নেতৃত্বে সফলতা আসবে না যদি না আমরা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ এবং আদর্শের প্রতি অটল থাকি। তাঁর জীবন একটি গৌরবময় ইতিহাস, যা আজও আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
এ.কে ফজলুল হক ছিলেন বাংলাদেশের একটি মাইলফলক, যিনি তাঁর জীবন দিয়ে শিখিয়েছেন কীভাবে রাজনীতি ও নেতৃত্বে সৎ, দেশপ্রেমিক এবং আদর্শবান থাকা যায়। তিনি একজন সাধারণ, ত্যাগী এবং গুণী নেতা ছিলেন, যিনি তাঁর জীবনের সকল মুহূর্ত দেশের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানো আমাদের কর্তব্য, এবং তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশের জন্য কাজ করার আগ্রহ তৈরি করতে হবে। তাঁর মতো গুণী মানুষের স্মরণ আমাদের প্রেরণা দিতে পারে এবং এটি আমাদের একটি ন্যায্য, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক; অধ্যাপক,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।