তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান শিক্ষক, অকুতোভয় জনপ্রতিনিধি, স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিত সংগঠক, যোদ্ধা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহচর, জাতীয় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি জাতীয় ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে তিনি সমৃদ্ধ হয়েছেন এবং নিজেকে শাণিত করেছেন। যে–ক’জন শুদ্ধ রাজনীতিবিদের কারণে রাউজান প্রগতি, স্বাধীনতা ও অসামপ্রদায়িক চেতনায় জননন্দিত হয়েছে, ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক তাঁদের অন্যতম।
প্রচারবিমুখ, জনারণ্য এড়িয়ে চলা এই মানুষটি সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্যকে ভেঙেছেন। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন কাজে ও প্রতিজ্ঞায়। তাঁর জীবন মহত্তে ভাস্বর। নিয়েছেন খুব সামান্য, দিয়েছেন নিজেকে উজাড় করে তাঁর সকল মেধা, শ্রম। এই দীপ্র মানবাত্মার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করছি তাঁর ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে।
তাঁর ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত জনপদের জননায়ক শীর্ষক প্রকাশনায় বিভিন্ন বিদগ্ধজনের স্মৃতিচারণে এই মনীষা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেছি। ওই প্রকাশনায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন রাজনীতিকবর্গ অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে এই ধীমান রাজনীতিককে যথাযথ মূল্যায়নের চেষ্টা করেছেন।
বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী তাঁর পরম হিতৈষী, বন্ধুপ্রতিম শিক্ষক, নন্দিত রাজনীতিবিদ, জাতির পিতার ঘনিষ্ঠজন, নিঃস্বার্থ সমাজহিতৈষী এ.কে ফজলুল হক চেয়ারম্যানের জীবন আলোচনা করে বলেন, ‘আমরা দেখি, তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং প্রথম জীবনে শিক্ষকতার ব্রত গ্রহণ করে মানুষের অন্তরে জ্ঞানের মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলনের চেষ্টা করেছিলেন।’
কবি–বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত হাফিজ খান রুশ্নি তাঁর দীর্ঘ কথামালায় এ.কে ফজলুল হক–এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁর তীক্ষ্মধী কলামে সেই সত্য উচ্চারণ করেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিভাসে এ গরীয়ান ঐশ্বর্য্য অসংখ্য সূর্যের আলোময় সম্ভাবনায় প্রোজ্জ্বল। আর এ প্রোজ্জ্বল অভিব্যক্তির ব্যনজনাকে ধারণ করেই বীর নগরী চট্টগ্রামের রাউজানের অকুতোভয় বীর, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, চট্টগ্রাম জেলা ও রাউজান থানা আওয়ামী লীগের অন্যতম কীর্তিমান সংগঠক, ১১নং পশ্চিম গুজরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং যুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনী প্রধান, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, রাউজানে সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক চেয়ারম্যানের সংগ্রামী জীবনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে নত মস্তকে বলেন, ‘তাঁর জীবনের মর্মবাণীই ছিলো-‘বীর বাঙালি আত্মসমর্পণ করতে পারেনা; পারেনা পরাজিত হতে।’
প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান–এর বয়ানে আমরা জানতে পারি, ‘১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকালে এ.কে ফজলুল হকের সাথে আমার পরিচয়। পরবর্তীতে সখ্যতা। সেই সখ্যতা আরো প্রগাঢ় হয় ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের মধ্য দিয়ে।’ তিনি বলেন, ‘১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত চট্টগ্রামে অবস্থানকালে ফজলুল হক সাহেবের সাথে আমার নিবিড় বন্ধুতা চলমান ছিলো। তিনি পরম বন্ধুবৎসল এবং আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলেন। যুদ্ধকালীন রাউজানে তাঁদের বাড়ি ‘ওছমান আলী মাস্টার বাড়িতে ছিলো স্বীয় ইউনিয়নের প্রধানতম সেল্টার হাউস। তিনি সেল্টার মাস্টার হিসেবে রাউজানে স্ব–নামে খ্যাত ছিলেন। নিজেদের বাড়ি ছাড়াও হাটহাজারী–রাউজানের অসংখ্য সেল্টার হাউস তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়।’ জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু হযরত আলহাজ্ব ওছমান আলী মাস্টারের সুযোগ্যপুত্র এ.কে ফজলুল হক পারিবারিক সম্পর্কে শিল্পী মুর্তজা বশীরের ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সে ছিলো আমার ছোটবেলার বন্ধু। ১৯৫০ সালে আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ফজলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। একসাথে থাকি–খাই–আড্ডায় সময় কাটে। সে সময় হাজং বিদ্রোহ চলাকালে আমারই আঁকা পোস্টার ছিড়ে যাওয়ায় জোড়া লাগাতে গিয়ে পুলিশের কাছে গ্রেফতার হলাম। চরম নির্যাতন ভোগ করি। আমার বন্ধুও গ্রেফতার। বিনাদোষে সে কারাভোগ করলো আমার সাথে। এটি এখনো আমাকে কষ্ট দেয়। দু’বন্ধু ভাষা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ বরকতসহ অন্য সহযোদ্ধাদের সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের অনেক বন্ধুর মধ্যে ফজলুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনীতি তাঁকে জননন্দিত করলেও তার সহযাত্রী অনেকেই ঈর্ষার চোখে দেখতো। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ তাকে যে গুরুত্বের চোখে দেখতো সেটিই চক্ষুশূল হয়েছিলো ফজলুর জন্য। পরবর্তীতে নিজ দলের অনেকেই ভেতরে ভেতরে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অনেকবার বলেও বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি, বঙ্গবন্ধুকে বিষয়গুলি খোলামেলা জানাতে।’
আজাদীর সাবেক সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ–এর স্মৃতিচারণে আমরা শুনি, ১৯৪৭ সালে কলকাতা ইসলামীয়া কলেজে ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম সরাসরি সাক্ষাত এবং ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে এ.কে ফজলুল হকের। সেই শুরু বঙ্গবন্ধুর সাথে তার যোগাযোগ। পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠতাও।’ ভাষাসৈনিক ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুণ চৌধুরী বলেন, ’৫৪ সালে এমএ আজিজের নির্বাচনী সমস্যা নিয়ে তিনিসহ ঢাকা গেলে সদরঘাট আওয়ামী লীগ অফিসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমি ও এ.কে ফজলুল হক দীর্ঘ আলাপ করি। সে সময় আওয়ামী লীগ নেতা আজিজ ভাই ‘এ.কে ফজলুল হক ও আমাকে’ ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বলে উল্লেখ করেন।’একুশের কালজয়ী গানের স্রষ্টা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কয়েক লাইন স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে আমার শ্রদ্ধানিবেদন শেষ করতে চাই। তিনি লিখেন, ‘… বঙ্গবন্ধু বললেন, চৌধুরী, চট্টগ্রাম থেকে ‘আমার গুপ্তচর’ এসেছে। তুমি তাকে সাথে নিয়ে যাও। বুঝতে বাকি রইলো না চট্টগ্রামের এ.কে ফজলুল হক এসেছেন। বঙ্গবন্ধু ভেতরে গেলে হাসিমুখে ফজলুল হক বেরিয়ে এলেন, বললেন–চলো তোমার সাথে যাবো। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সমীহ করতেন আর বঙ্গবন্ধু তাঁকে তাঁর নিজস্ব ‘গুপ্তচর’ বলতেন। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নানা গ্রুপিংকে ‘হক’ সাহেব ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ করতে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ভ্যানগার্ড হিসেবে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুজন ফজলুল হক বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।
ফজলুল হক মাত্র ৫৫ বছর বয়সে আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুকেও মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরদের অনেকেই মুখ লুকিয়ে ছিলেন। সেই দুঃসময়ে ফজলুল হকের প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে অনেক তরুণ নেতৃত্ব উজ্জীবিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর তাঁর উপর অকথ্য জুলুম–নির্যাতন হয়েছে। ফকা চৌধুরীর গুডস হিলে নিয়ে গিয়ে তাঁকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। জীবন্মৃত অবস্থায় তাঁর পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হয়।’
এ.কে ফজলুল হক জীবনব্যাপী কর্মসাধনায় সকল সহকর্মী ও আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। আমরা ক্রমশই যদি তাকে ছড়িয়ে দিতে পারি সবখানে, তবেই হয়তো একটি বাসযোগ্য ভূমি এবং সহনশীল সময়কে খুঁজে নিতে পারি।’
লেখক : বার্তা সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ।