বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাশে বঙ্গবন্ধু এক অপার বিস্ময়। বিস্ময়কর এক জাতীয়তাবাদী নেতার উত্থান আমরা দেখেছি এই উপমহাদেশে। তিনি সারাবিশ্বে সমাদৃত উচ্চারিত বাঙালি জাতির নতুন রূপকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা পুরুষ। এক অবিসংবাদিত নেতা।
তিনি ভৌগলিক একটি নিজস্ব কাঠামো চেয়েছেন সমাজ মানস চেতনার ভেতরে নির্দিষ্ট ভাষাপ্রতীম জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্ক্ষার উদঘাটক হিসেবে। ক্রমে ক্রমে একটি জাতি বিকাশের ধারণা তাঁর মধ্যে রোপিত হতে থাকে তাঁর যৌবনকাল থেকে। তিনি বুঝেছিলেন দেশ ও রাষ্ট্রের ভৌগলিক স্বাধীনতা এবং স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বুননের হাতিয়ার এই অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা। মূলত দেশ বিভাগ থেকে ভাষাভিত্তিক এই জনগোষ্ঠীর কথা ও লেখার স্বাধীনতা স্মরণে রেখে ভাষা রাষ্ট্রের কথা ভাবতে থাকেন তিনি। বস্তুত ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এর বিস্তৃত করিডোরে ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রাম একই সুতোয় গাঁথা এক অমর মহাকাব্য। এই মহাকাব্য মহাকর্ষ ছেড়ে পৌঁছে যায় বাঙালির ঘরে ঘরে। ১৯৪৭ এ ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের জন্মের আগে পাকিস্তানি শাসকদের স্বরূপ উন্মোচিত হতে থাকলে বঙ্গবন্ধু তখনকার যুবসমাজের মধ্যে নিজেদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি খুব কৌশলে এগিয়ে নিয়ে আসেন। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল কলকাতার সিরাজদ্দৌলা হোটেলের একটি কক্ষে। এই স্বল্প আয়তনিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন – কাজী ইদ্রিস, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, রাজশাহীর আতাউর রহমান, আখলাকুর রহমান। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে পূর্ববঙ্গের যুব সমাজের কী করণীয় হতে পারে!
ভাষা সমাজ মানসের মস্তিষ্কজাত একটি অপার মানসিক ক্ষমতা। অর্থময়ী ঈঙ্গিত – প্রতি ঈঙ্গিতে কিংবা বাক সংকেতের মাধ্যমে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ ক’রে। যোগাযোগের প্রধানতম বাহন ভাষা। ভাষা পরিবেশ নির্ভরতায় পুষ্টি পেতে থাকে। এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলো ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হতে থাকে। ভাষার ক্ষমতায়ন হয় একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক সমাজের অন্তর্গত স্রোতে। আমরা সহস্র বছরের বাঙালি মাতৃভাষায় বর্ণ চর্চা ও অনুভূতির বিনিময়ের মাধ্যমে রাজনীতি ও সাহিত্যের বিকাশমান পর্বগুলো বিবেচনা ক’রি। ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমলের শাসন কাঠামোয় ভাষার আবেদন এবং মানবিক বৈশিষ্ট্য আমরা বুঝতে সক্ষম ছিলাম না। আমরা প্রতিনিয়ত চাপিয়ে দেয়া ভাষা ঔপনিবেশিক পাকিস্তান স্বৈর শাসকের কণ্ঠ আতংকে তটস্থ ছিলাম। ভাষার বিন্যাসিত ক্ষমতায়ন নির্দিষ্ট জাতি বিকাশের ধারনা অস্তিত্ববান হলেও আমাদের অপরিণত করে রেখেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।
এখন আসা যাক, বঙ্গবন্ধু কীভাবে ভাষা চিন্তাকে সামনে এগিয়ে নিলেন তাঁর উচ্চারিত অনুভূতি নিয়ে;
‘আমরা বাঙালি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমি যদি ভুলে যাই আমি বাঙালি, সে দিন আমি শেষ হয়ে যাবো। আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা। বাংলা আমার মাটি, আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরবো, বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা আমার কৃষ্টি ও সভ্যতা’। এভাবেই ভাষার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণের সবক বঙ্গবন্ধু রেখে গেছেন বাঙালির রাজনৈতিক চেতনায়। কখনো কখনো এ-সব প্রসঙ্গ একজন ভাষাতাত্ত্বিকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এই কথার সমর্থনে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৫, ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ’ ;
‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতিরোধ করতে পারে না। তিনি উদাত্ত আহবান করেন বুদ্ধিজীবীদের সব ভেদাভেদ ভুলে স্বজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলুন। আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রামের সাহিত্য রচনা করুন, বাঙালিজাতি একতাবদ্ধ হলে কেউ বাধা দিতে দুঃসাহস দেখাবে না’। এভাবেই ৫২ ভাষা আন্দোলনে গভীর সম্পৃক্ততা ও ভাষা চেতনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ জানুয়ারি মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, যখন বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। নাজিমুদ্দিনের একরোখা ঘোষণায় ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। জেল থেকেই গোপনে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের দিক নির্দেশনা দিতে থাকেন। আন্দোলনকারীদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কীভাবে রক্ষা ক’রা যাবে এই ভেবে শরীর অসুস্থতার উছিলায় ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট করবে স্থির হয়েছিল। জেলে দেখা হয় আরও কয়েক নেতার সাথে। বরিশালের মহিউদ্দিন তাদের অন্যতম। ২১ তারিখ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছাত্ররা সারাদেশে ছড়িয়ে দেবে এই সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়।
বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, ভাষা কেবল কি শুধুই মনন ও মননের ভাব প্রকাশের মাধ্যম! ভাষার অন্তর্গত স্রোতে জড়িয়ে আছে দেশ ও জাতির আত্মপরিচয়। সহস্র বছরের একটি জাতির উন্মেষপর্বের অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দেশ বিভক্তির পর এটি সবার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়, ১২শ মাইলের ব্যবধানে দুটি ভূখণ্ডের সাহিত্য সংস্কৃতি ও মুখের ভাষা কখনোই এক হতে পারে না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে দুটো ভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতা থাকা সত্ত্বেও এক অদ্ভুত ঘৃণ্য কাঠামোয়। তখনও পর্যন্ত উভয় প্রদেশে ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে ৭.২ শতাংশ জনগোষ্ঠী কথা বলতো উর্দুতে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এবং ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্বপাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগের সভায় বঙ্গবন্ধু একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আগাগোড়া একজন মেঠো বাঙালি। গ্রাম্য আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পচ্ছন্দ করতেন।
তিনি ভীষণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারণ করতেন কত নেচ, কত দেচ, কত দেবা। ৭ ই মার্চের ভাষণে তিনি দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দিয়েছিলেন তোমরা আমাদের দাবাইয়া রাখতে পারবানা, বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ বাঙালির ভাষা চেতনার দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ। বাঙালিকে সাহস যুগিয়েছে বঙ্গবন্ধু। বাঙালির স্বপ্ন ও প্রেরণার উৎসস্থল বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের প্রকৃত জন্ম ৭ই মার্চ ১৯৭১ সাল। একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি দেশের জন্ম হয়েছিল সেদিন। ভাষা ও অনুভূতির চিৎকারে একটি অভিনব জাতীয় কবিতার উন্মেষ ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে আলাদা মানচিত্র-একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।