ভাষাগত দূরত্বও কারণ আট সুপারিশ

বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষ : তদন্ত প্রতিবেদন

| সোমবার , ২৪ মে, ২০২১ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষের জন্য চীনা প্রকৌশলীদের সঙ্গে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভাষাগত দূরত্বও কারণ হিসেবে খুঁজে পেয়েছে পুলিশের তদন্ত কমিটি। তাই দেশি শ্রমিকদের সঙ্গে চীনা প্রকৌশলী ও অন্যদের দূরত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এছাড়া নির্ধারিত সময়ে বেতন না পাওয়া, বহিরাগতদের প্রভাবও শ্রমিক অসন্তোষের কারণ হিসেবে দেখিয়েছে এই তদন্ত কমিটি। বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নে এস আলম গ্রুপ ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। গত ১৬ এপ্রিল সেখানে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচ শ্রমিক মারা যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরও দুজন। খবর বিডিনিউজের।
সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধানে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তারকে প্রধান করে আরেকটি তদন্ত কমিটি করে। পুলিশের তদন্ত কমিটি গত ১৯ মে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। ২৯৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা এড়াতে আটটি সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বাংলাদেশি ও চীনা মিলে সাড়ে চার হাজার লোক কাজ করে। তাদের মধ্যে ভাষাগত কারণে যোগাযোগের ব্যাঘাত ঘটায় দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ১৭ এপ্রিলের সংঘর্ষের ঘটনায় ভাষাগত জটিলতা কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি বলে জানান তিনি। অন্য কারণগুলো হলো, মাসের ১০ তারিখের মধ্যে বেতন না পাওয়া, শ্রমিকদের বাসস্থান ও স্যানিটেশন সমস্যা, রোজায় কর্মঘণ্টা হ্রাসের দাবি, নামাজের ছুটির দাবি, কিছু কিছু কারণে চীনা প্রকৌশলীদের খারাপ আচরণ ও শ্রমিক সরবরাহে বহিরাগতদের প্রভাব। রোজার সময় ১০ ঘণ্টার পরিবর্তে আট ঘণ্টা কাজ করে সম্পূর্ণ বেতন, শুক্রবার জুমার নামাজ পর্যন্ত আধাবেলা কাজ করার দাবি জানিয়েছিল শ্রমিকরা। নামাজের সময়ে শ্রমিকরা নামাজ পড়তে যাওয়ায় বেতন কাটার ঘটনা ঘটেছে। যা ধর্মীয় অনুভূতি হিসেবে আন্দোলন ‘বেগবান’ করেছে বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
ডিআইজি জাকির বলেন, জনশ্রুতি আছে, এক চীনা প্রকৌশলী বাংলাদেশি এক শ্রমিককে লাথি দিয়েছিল, যা সংঘর্ষ সৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছিল। কিন্তু তদন্ত কমিটির সেটার সত্যতা খুঁজে পায়নি।
তদন্ত কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম রেঞ্জ কার্যালয়ের পুলিশ সুপার নেছার উদ্দিন আহমেদ বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যেটা দেখেছি শ্রমিকদের দাবি দাওয়া উপস্থাপনের মতো কোনো লোক নেই। যে কারণে শ্রমিকদের বিভিন্ন বিষয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতদের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা যায়নি।
বিক্ষোভে যুক্ত হতে অনেক শ্রমিক রাজি ছিলেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকেরা যে নয় দফা দাবি দিয়েছে তার মধ্যে রোজায় কর্মঘণ্টা হ্রাস ছাড়া আটটি দাবি কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়টি শ্রমিকদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছায়নি।
এছাড়া শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি তাদের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানালেও তারা সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত চীনাদের জানায় না বলেও তদন্তে উঠে এসেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে এস আলম গ্রুপের ৭০ শতাংশ এবং চীনা কোম্পানি সেফকোথ্রি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।
বহিরাগতদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির বলেন, রশিদ ও নূর আলম নামে স্থানীয় দুই ব্যক্তি শ্রমিক সরবরাহসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন। ঘটনার দিন সকালে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করলে রশিদ লোকজন নিয়ে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এসময় এক শ্রমিকের গায়ে হাত তুলেছিলেন রশিদ। এতে কিছু শ্রমিক আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
বিক্ষোভে পুলিশের গুলি চালানোর বিষয়ে তিনি বলেন, সংঘর্ষের শুরুতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ১২ জন পুলিশ সদস্য। শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন ডাম্প ট্রাকে আগুন দেয়। পুলিশের উপর হামলা শুরু করে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অস্থায়ী মসজিদের মাইক থেকে চীনা নাগরিকদের উপর হামলা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে প্রথমে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছিল। পরে বাধ্য হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। তদন্ত কমিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বহিরাগত প্রবেশ রোধ এবং নিরাপত্তা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান জাকির বলেন, প্রতিবেদনে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, কেপিআইয়ের মতো করে পুলিশের পাশাপাশি নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে সুপারিশ করা হয়েছে। শ্রমিকদের সঙ্গে প্রকল্পে কর্মরত চীনা নাগরিকদের দূরত্ব কমাতে ‘শ্রমিক কল্যাণ প্ল্যাটফর্ম’ তৈরি করে কিছুদিন পরপর প্রশাসনসহ উভয় পক্ষ মিলে বৈঠকের সুপারিশও করা হয়েছে।
তিনি জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিক, নির্মাণ ব্যবস্থাপনায় থাকা চীনা নাগরিক, পুলিশসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৬০ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন তারা। যাদের মধ্যে ২০ জন শ্রমিক।
ডিআইজি আনোয়ার বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন দেখে পুলিশ সদর দপ্তর করণীয় ঠিক করবে।
সংঘর্ষের ঘটনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা এক হাজার ৪০ জনকে আসামি করে একটি মামলা হয়। পাশাপাশি কারও নাম উল্লেখ না করে অন্তত আড়াই হাজার জনকে আসামি করে পুলিশের পক্ষ থেকে আর একটি মামলা করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ
পরবর্তী নিবন্ধফের চালু হচ্ছে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির অ্যাসাইনমেন্ট