ভালো ফলনেও ক্ষতি, ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় আগ্রহ কমছে পানচাষির

মীরসরাইয়ের হিঙ্গুলী ও বারৈয়াঢালা

মীরসরাই প্রতিনিধি | শনিবার , ৯ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মহেশখালীর মিষ্টি পানের চাহিদা রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে। তবে এই মিষ্টি পানের উৎপাদন শুধু মহেশখালীতেই নয় মীরসরাইয়ের হিঙ্গুলী গ্রাম ও বারৈয়াঢালাও পান চাষের জন্য বিখ্যাত। বারৈয়ারহাট বাজারটি ‘পানের বারৈ’ (পান বিক্রেতাদের) হাট থেকেই নামকরণ। আবার বারৈয়াঢালা ইউনিয়নটিও পানের বারৈ থেকে নামকরণ। বর্ষার এই মৌসুমে মীরসরাই এলাকার পানের বরজগুলো এখন সেজেছে মনোরম সাজে। সারি সারি পানের সুমিষ্ট সমিরণে কৃষকদের মনেও এখন বেশ আনন্দ। কোন প্রকার প্রাকৃতিক বৈরিতা না হলে এবার ভালো ফলনই আশা করছে কৃষকরা।

কিন্তু বর্তমানে উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজার মূল্য কম থাকা, উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি ও সংকট, প্রয়োজনীয় ঋণ ও প্রশিক্ষণের অভাবে মীরসরাই উপজেলার হিঙ্গুলী ও বারৈয়াঢালার পান চাষিরা পান চাষে সফলতা পাচ্ছে না। ফলে পান চাষে তাদের আগ্রহ কমে গেছে।

জানা যায়, পানের বরজ তৈরির জন্য বাঁশ, খুটা, ছন, নলের ঝাঁটি, খৈল ইত্যাদি কেনার জন্য মহাজন বা ব্যাংক থেকে মোটা সুদে টাকা এনে যথাসময়ে সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক সময় চাষিদের কমমূল্যে পান বিক্রি করতে হয়। ফলে পূর্বের ঘাটতি পূরণ করতে চাষিদের আবার সেই মহাজন বা ব্যাংকের কাছে যেতে হয়। এভাবে চক্রাকারে তাদের আর্থিক সংকটে পড়তে হচ্ছে।

এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক এ পাঁচ মাস পর্যন্ত পান চাষে অধিক ফলন হয়ে থাকে। এখানে সাধারণত ঝাল পান হয়ে থাকে। এখানকার পানের সাইজ অন্য অঞ্চলের তুলনায় বড়। বরজ তৈরির জন্য উঁচু জায়গার প্রয়োজন। পানের বরজ করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়ে বাঁশ, ছন ও খৈলের। অথচ এগুলোর বর্তমানে সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভাদ্র থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত খৈলের প্রয়োজন পড়ে। এগুলো না দিলে পান গাছের মূলে পচন ধরে। পান চাষে ব্যবহৃত বাঁশের খুঁটি ও ছন পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা হতো। বর্তমানে সরকারের বনবিভাগ সেখানে বাগান করার কারণে বাঁশছনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

হিঙ্গুলী এলাকার পান চাষিরা জানান, ‘কবুতর পাড়ি’ ও ‘ছাগ পাড়ি’ নামে দুধরনের রোগে আক্রান্ত হয় পানের বরজ। শীতের অতিরিক্ত কুয়াশা, অধিক খরা ও রোগবালাইয়ের কারণে গাছ থেকে পান ঝরে যায়। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং শিলাবৃষ্টির কারণে পানের বরজে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।

পানচাষি পরিমল দে জানান, ফেনী, বারৈয়াহাট ও মিঠাছড়া বাজারে প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার পানের হাট বসে। কিন্তু ভারত থেকে অবৈধ পথে (ছাগলনাইয়া) ব্যবসায়ীরা পান বিক্রির জন্য এখানকার হাটে আসায়

কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পায় না। অবৈধপথে পান বিক্রি বন্ধ করলে এখানকার কৃষকরা লাভবান হবে মনে করছেন তারা।

বারৈয়াঢালা পান চাষি সমবায় সমিতির কার্যকরী সদস্য সুজিত নন্দী জানান, ৭০ শতক জমির পান চাষ করতে গত তিন বছরে প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ পড়ে। উপকরণ ও শ্রমিকের মূল্যে বৃদ্ধি এবং পানের বরজে রোগ বালাইসহ ইত্যাদি কারণে তিন বছরের শেষে এসে হিসাবে দেখা যায় তার ৫০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। তার এই লোকসানের হিসাব দেখে পান চাষের প্রতি আগ্রহ কমে যাবার কথা। কিন্তু আদি পেশা হিসেবে তিনি এখনো বুকে ধারণ করে আছেন। লোকসানের কথা ভুলে গিয়ে তিনি আবারো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তার জমিতে পান চাষে মনোযোগী হলেন। বারৈয়াঢালা গ্রামের সকল পান চাষিদের মুখে একই কথা ‘বাপ দাদার’ পেশা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য এই পান চাষ করা।

বারৈয়াঢালার পান চাষি সুনীল চন্দ্র নাথ বলেন, আমার এলাকার সবাই দরিদ্র কৃষক। পানের প্রধান উপকরণ হচ্ছে বাঁশ। পাহাড়ি এলাকায় বাঁশ না থাকায় অধিক মূল্যে দিয়ে অন্য জায়গা থেকে বাঁশ ক্রয় করতে হয়। প্রায় সময় পান ক্ষেতে রোগ বালাই থাকে। কৃষি বিভাগ থেকে ন্যায্যমূল্যে সার, কীটনাশক, খৈলসহ বিভিন্ন উপকরণ প্রদান করলে কৃষক ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত হতো। মীরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায় জানান, পানচাষীদের বিষয়ে আমি ও স্থানীয় সুপারভাইজারের মাধ্যমে আমার এলাকায় কিছু প্রশিক্ষণসহ প্রণোদনার উদ্যোগ গ্রহণ করবো। বিশেষ করে, আমার এলাকা হিঙ্গুলী ও খৈয়াছড়া অংশে পানের ঐতিহ্য রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅর্কেষ্ট্রার দুই দিনব্যাপী কর্মশালা
পরবর্তী নিবন্ধআমরা ক’জনা পূজা উদযাপন পরিষদের স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন