স্ট্র্যান্ড রোড। ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির অবস্থান নগরের সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত। প্রতিদিন শত শত পণ্যবাহী বিভিন্ন ট্রাক ও কাভার্ড্যান চলাচল করে এ সড়ক দিয়ে। এই সড়কের পাশে রয়েছে বন্দরের ৬টি জেটি, গার্মেন্টস ও সরকারি একটি তেল কোম্পানির প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বন্দর দিয়ে আসা বিভিন্ন পণ্য লাইটার জাহাজ থেকে স্ট্র্যান্ড রোড সংলগ্ন জেটি দিয়ে খালাস হয়। খালাসকৃত পণ্য এই সড়ক দিয়েই চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে এই সড়কের গুরুত্ব অনেক।
তবে গত সপ্তাহে সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে, ছোট–বড় অসংখ্য গর্ত রয়েছে এই সড়কের বিভিন্ন অংশে। কোনো কোনো গর্তে জমে ছিল পানি। কয়েক জায়গায় তো রীতিমতো পুকুরের মত রূপ নিয়েছে। অবশ্য বৃষ্টি না হওয়ায় সেই পানি শুকিয়ে গেছে গত দুইদিনে। তবে ইট–কংক্রিট ও বিটুমিন ওঠে সৃষ্ট গর্তের জন্য এই সড়কে যানবাহন চলাচল করতে চালকদের যে বেগ পেতে হচ্ছিল তার অবসান হয়নি। কয়েকজন চালক আজাদীকে জানিয়েছেন, সড়কটির বিভিন্ন গর্তে পড়ে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। নষ্ট হয় গাড়ির মূল্যবান যন্ত্রপাতি। উল্লেখ্য, কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ২০২০ সালে জাইকার অর্থায়নে দুইটি প্যাকেজে সড়কটির উন্নয়ন কাজ করেছিল চসিক।
দৃশ্যপট– ২ : বহাদ্দারহাট–খতিবের হাট সড়ক। প্রধান সড়ক না হলেও প্রতিদিন হাজার হাজার লোক চলাচল করে এই সড়ক দিয়ে। এই সড়ক দিয়ে যাওয়া যায় সুন্নিয়া মাদ্রাসা। প্রতিদিন অসংখ্য রোগী ও তাদের স্বজন এই সড়ক হয়ে শমসের পাড়া চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ আসা যাওয়া করেন। মোহাম্মদপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকার লোকজনও ব্যবহার করেন এই সড়ক। তবে বেহাল হয়ে আছে এই সড়কও। সড়কের বেশিরভাগ অংশ ভাঙাচোরা। সৃষ্টি হয়েছে গর্ত। বৃষ্টি হলে পানি জমে। বৃষ্টি একটু বন্ধ হলে জমে কাদা। এই সড়ক নিয়মিত ব্যবহারকারী গল্পকার হিমেল মাহমুদ আজাদীকে বলেন, খতিবের হাট সড়কের কালারপুলের আগে ও পরে অবস্থা বেশি খারাপ। রাস্তা খারাপ থাকায় মাঝেমধ্যে পার্শ্ববর্তী খালে রিকশা পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তা ভাঙা এই অজুহাতে রিকশাচালকরা আদায় করেন বাড়তি ভাড়া।
চসিকের দায়সারা ভাব? : ক্ষতিগ্রস্ত স্ট্র্যান্ড রোড ও বহাদ্দারহাট–খতিবের হাট সড়ক–এর দুটো কেস স্টাডি থেকে স্পষ্ট, নগরের ভাঙা সড়কের জন্য দুর্ভোগ হচ্ছে সাধারণ মানুষ থেকে গাড়ির চালকদেরও। সরেজমিন পরিদর্শন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা, এই সড়ক দুটোর মত বেহাল দশা সড়কের বেশিরভাগ সড়কের। মোজাম্মেল নামে এক চাকুরিজীবীর দাবি করেছেন, ‘শহরের একটি সড়কও ভালো নেই। প্রতিটি সড়কের ক্ষতবিক্ষত, কোথাও না কোথাও নষ্ট হয়েছে।’ ভাঙা সড়কের জন্য নগরবাসী দুর্ভোগে থাকলেও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এক্ষেত্রে উদাসীন বলেও দাবি করেন তিনি। মোজাম্মেল–এর দাবি কতটা সত্য? তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, গত ১১ জুলাই শহরের ভাঙা সড়কের একটি তালিকা করে চসিক। ওই তালিকার পর দুই মাস পার হলেও তালিকাভুক্ত ভাঙা সড়ক পুরোটা সংস্কার করতে পারেনি চসিক। এসময়ে উল্টো নতুন করে নষ্ট হয়েছে অনেক সড়ক। চসিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়সারা ভাবের জন্য এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন পারভেজ নামে এক নাগরিক।
২৭ দিন ধরে সংস্কার কাজ বন্ধ : চসিক নিজস্ব অ্যাসপল্ট প্ল্যান্ট থেকে তৈরি মিক্সার (ইট, বালি, সিমেন্টে, বিটুমিনের মিশ্রণ) দিয়ে বর্ষায় ক্ষতি হওয়া সড়কের ছোট ছোট গর্ত ভরাট করে থাকে। সংস্থাটির ভাষায় এটি প্যাঁচওয়ার্ক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২৭ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে এ প্যাঁচওয়ার্ক। সর্বশেষ ২ সেপ্টেম্বর প্যাঁচওয়ার্ক করেছিল সংস্থাটি। অবশ্য প্যাঁচওয়ার্ক না করলেও মাঝেমেধ্যে সড়কের বিভিন্ন গর্তে ইটের খোয়া দিয়ে সাময়িক ভোগান্তি লাঘবের চেষ্টা করে সংস্থাটি।
চসিকের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সাথে আলাপকালে জানা গেছে, সরকার পতনের পর ইস্টার্ন রিফাইনারির প্ল্যান্ট বন্ধ থাকায় মিঙার তৈরির উপকরণ বিটুমিন সংগ্রহ করতে পারেনি চসিক। ফলে কাজ বন্ধ ছিল। মাঝখানে উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার থেকে বিটুমিন ধার ধরে কয়েকদিন প্যাঁচওয়ার্ক করে। অবশ্য ইস্টার্ন রিফাইনারির প্ল্যান্ট চালুর পর গত গয়েকদিন আগে ৪০ টন বিটুমিন সংগ্রহ করা হয়। এ অবস্থায় আগামী রোববার থেকে বৃষ্টি না হলে আবারো প্যাঁচওয়ার্কের মাধ্যমে সড়ক সংস্কার করার পরিকল্পনা আছে চসিকের।
এ বিষয়ে মিঙার প্ল্যান্টের দায়িত্বে থাকা চসিক প্রকৌশলী তৌহিদুল ইাসলাম আজাদীকে বলেন, প্রায় ৮ হাজার টন বালিপাথর মজুদ আছে। বিটুমিন সংগ্রহ করা হয়েছে। রোববার থেকে প্ল্যান্ট চালু হবে। যে পরিমাণ উপকরণ মজুদ আছে তা দিয়ে ১৫/২০ দিন সংস্কার কাজ চালানো যাবে।
জানা গেছে, চলতি ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরে প্যাঁচওয়ার্কের মালামাল ক্রয়ে ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হযেছে। গত ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরে ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও খরচ হয় ১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। ওই বছর প্রকল্পের আওতায় সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হয় বেশি। তাই প্যাঁচওয়ার্কে কম খরচ হয়।
বেহাল শহরের অন্যান্য সড়কও : জুলাই মাসে প্রস্তুতকৃত চসিকের তালিকা অনুযায়ী, নগরের ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৬টি ওয়ার্ডে ১ লক্ষ ২১ হাজার ৮১৪ বর্গমটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ বর্ষায়। নষ্ট হওয়া সড়কের প্রস্থ ১০ ফুট ধরলে ক্ষতির পরিমাণ হবে প্রায় ৪২ কিলোমিটার। পুরো শহরকে ৬টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রস্তুতকৃত ওই তালিকা অনুযায়ী, ১নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী, ৩নং পাঁচলাইশ, ৩৬ নং গোসাইলডাঙ্গা, ২৬নং উত্তর হালিশহর এবং ৩৭নং মধ্য হালিশহর; এই পাঁচ ওয়ার্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক নেই। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ২ নম্বর অঞ্চলের অধীন ৫নং মোহরা ওয়ার্ডে। যার পরিমাণ ২৫ হাজার ৯৭৪ বর্গমিটার। এছাড়া ৪নং অঞ্চলের অধীন দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে সবচেয়ে কম ৪১ দশমিক ৮২ বর্গমিটার সড়ক ক্ষতি হয়।
এদিকে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বিটুমিন, ইট, বালি ওঠে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট–বড় গর্ত। এতে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর সড়ক, মুরাদপুর–অঙিজেন সড়ক, জামাল থেকে আসকারদীঘি, ওয়াসা, নিমতলা, বারিকবিল্ডিং, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন জায়গায় বেহাল দশা। সিডিএ এলিভেটেড এঙপ্রেস ওয়ে এর যে অংশে র্যাম্প নামাচ্ছে সেখানে অবস্থা বেশি খারাপ। এছাড়া হালিশহরসহ কিছু জায়গায় ওয়াসার খোঁড়াখুড়ির জন্য নষ্ট হচ্ছে সড়ক।
কাজী সালাহ উদ্দীন নামে এক পথচারী স্ট্র্যান্ড রোডের জন্য দুর্ভোগ হয় বলে জানান। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে সড়কটির অবস্থা খারাপ। তবু সিটি কর্পোরেশন চুপচাপ বসে আছে।
চসিকের ৪ নম্বর অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার জাহান আজাদীকে বলেন, আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় স্ট্র্যান্ড রোড সংস্কার করা হবে। প্রকল্পের কনসালটেন্ট ডিজাইনের কাজ করছেন। আশা করছি খুব দ্রুত সমাধান হবে। এ প্রকৌশলী বলেন, পুরো সড়কের অবস্থা খারাপ নয়। সড়কের একটি কালভার্টের আগে ও পরের অংশে বেশি খারাপ। বাকি জায়গার কিছু অংশে বৃষ্টির কারণে ছোটখাট কিছু গর্ত হয়েছে। ৪ নম্বর অঞ্চলের অন্যান্য এলাকার সড়কের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেইন রোডে তেমন সমস্যা নেই। হালিশহরে ওয়াসার কাটিং চলছে, সেখানে এ কাটিংয়ের জন্য সড়কের ক্ষতিটা বেশি হচ্ছে। অন্যান্য জায়গায় বৃষ্টির কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে।
চসিকের ৬ নম্বর অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, যেখানে এলিভেটেড এঙপ্রেস ওয়ে এর র্যাম্প এর কাজ চলছে সেখানে খারাপ অবস্থা বেশি। সল্টগোলা–সিমেন্ট ক্রসিং এবং বিমানবন্দর সড়কে কিছু কাজ করেছি এক সপ্তাহ কাজ করলে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। এতদিন বিটুমিন সংকট থাকায় কাজ আটকে ছিল।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী শাহীন–উল ইসলাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, বিটুমিনের সংকট দূর হয়েছে। কাল থেকে প্ল্যান্ট চালু করতে বলেছি। প্রধান নির্বাহী কর্মকতা শেখ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, কাজ শুরু হবে। আমি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে মনিটরিং করব। কোথাও গাফেলতি দেখলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।