বাঙালি নারীদের অদম্য সাহসিকতার উদাহরণ দিতে গেলে প্রথমেই চলে আসে বীরকন্যা প্রীতিলতার নাম। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। যার ডাক নাম রানী। ছদ্মনাম ফুলতার। মাষ্টারদা সূর্য সেন প্রীতিলতাকে ফুলতার নামেই ডাকতো। মাত্র ২১ বছর এই বাঙালি নারী দেশের জন্য জীবন দিলেন বীরের মতো দুর্বার সাহসিকতার সাথে এই গল্প ছোটবেলা শুনে শুনে বড় হয়েছি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের গুরু মাষ্টারদা সূর্য সেনের অধীনে পরাধীনতার ঘেরাটোপ থেকে দেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দেয়ার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের অন্যতম কাণ্ডারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাটে জন্ম। বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরে। আসকার দীঘির পাহাড় ঘেরা পরিবেশ থেকেই হয়তো পেয়ে যান প্রকৃতি পাঠ। মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচার বাসনা। স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করা, এসব তো একদিনের বিষয় নয়। বিন্দু বিন্দু করে মনের মধ্যে একদিন এক বিশাল সরোবরের অস্তিত্ব মেলে। প্রীতিলতার বাবার নাম জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার। মায়ের নাম প্রতিভা দেবী। প্রীতিলতারা ছয় ভাই বোন। চার বোন, দুই ভাই। মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী স্কুল ডাঃ খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন প্রীতিলতা। ঢাকা বোর্ডে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে পঞ্চম স্থান অধিকার করে সরকার থেকে কুড়ি টাকা বৃত্তি পায় প্রীতিলতা। আর সেই বৃত্তির টাকার জোরেই কলকাতার বিখ্যাত বেথুন কলেজে দর্শন শাস্ত্রে অনার্সে ভর্তি হয়। পরে অবশ্য বিপ্লবী কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য অনার্স সম্পন্ন না করে ডিস্টিংশনে বিএ পাস করে আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসে। যদিও চট্টগ্রামে ফিরে আসার নেপথ্য কারণ ছিল সশস্ত্র বিপ্লবে সরাসরি অংশগ্রহণ করা। পাশাপাশি চট্টগ্রামে নন্দনকাননে গড়ে ওঠা নন্দনকানন বালিকা বিদ্যালয়ে (যা বর্তমানে অপর্ণা চরণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত) প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা থাকাকালীন সময়েই একদিন মাষ্টারদার নির্দেশে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র হামলার নেতৃত্ব দেন এবং সফল ভাবে হামলা পরিচালনা করে ফিরে আসার শেষ মুহূর্তে পুলিশের গুলিতে আহত হলে দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে নিজেদের শপথের কথা মনে রেখেই নিজের সঙ্গে থাকা পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন, যাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তাদের অত্যাচারে বিপ্লবীদের গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে না যায়।
এই হলো মোদ্দাকথায় আমাদের বীরকন্যা প্রীতিলতা।
তাহলে বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের বই ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’য় এমন কি আছে যে কারণে এই বইটি পাঠের তালিকায় রাখতে হয়। আছে, প্রীতিলতার মন তোলপাড় করা এক অধ্যায় এই বইটিতে। জানা হয় রামকৃষ্ণ বিশ্বাস নামক ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত বিপ্লবীর কথা। যে বিপ্লবীকে প্রীতিলতা ভালোবেসেছে। যাকে দেখতে ৪০ বার আলীপুর জেলখানায় গিয়েছিল প্রীতিলতা। ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলার সময়ও প্রীতিলতার জামার ভেতর বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি ছিল। বিপ্লবী হলেও ২১ বছর বয়সী এক নারীর মন ঠিকই সমানতালেই বেড়ে উঠেছিল প্রীতিলতার মননে। তাই তো কন্ঠে তার দৃঢ় উচ্চারণ, ‘বিপ্লবী বলে আমি নারী হব না কেন? আমার কি কাউকে ভালো লাগতে পারে না? ’
বিপ্লবীদের প্রেম ভালোবাসা নিয়ে আপত্তি ছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখার প্রেসিডেন্ট মাষ্টারদা সূর্য সেনের। তিনি নিজেও নাকি স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রাখেননি। বিপ্লবী দলে যোগ দেয়া মেয়েদেরকে ছেলেদের কাছ থেকে দূরে রাখার নির্দেশনা ছিল।
এসব বাধা পেরিয়েও প্রীতিলতার মন বাঁধা পড়ে যায় জেলের ফাঁসির আসামি রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের প্রতি। আর তখনই বইটার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। মনে হচ্ছিল রামকৃষ্ণ বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে হবে। এই ফাঁসির আসামির কী এমন বিশেষত্ব আছে যে কারণে প্রীতিলতার মতো একজন তার জন্য দুর্বল হয়।
ক্রেইগ হত্যার ব্যর্থ অপারেশন এর কথা আছে বইতে। তৎকালীন সময়ে বাংলার পুলিশ প্রধান লোম্যানকে বিপ্লবীরা হত্যা করার পর ক্রেইগ লোম্যানের স্থলাভিষিক্ত হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে ক্রেইগকে হত্যা করে বিপ্লবীরা ব্রিটিশ শাসকদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিল। ক্রেইগ হত্যার দায়িত্ব দেয়া হয় রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে। তার সঙ্গী ছিল কালীপদ নামে আরেকজন বিপ্লবী।
মাষ্টারদা এই হত্যার দায়িত্ব দেয়ার সময় রামকৃষ্ণকে বলেন, ‘না মেরে ফিরে আসবে না।’
হত্যার মতো গুরুতর বিষয়ে এই কথা নির্মম শোনালেও বাস্তবতার নিরিখে এই বক্তব্য ছিল জীবনের প্রাণশক্তি। আর তাই জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে নিহত নয়জন শহীদকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহায় চঞ্চল হয়ে ওঠে রামকৃষ্ণ। ক্রেইগকে হত্যা করবে এ–যেন এক আরাধ্য বিষয়ে পরিণত হয় রামকৃষ্ণের কাছে। রামকৃষ্ণ ভাবেন, ‘হত্যা শব্দটি তখন কী এক অসাধারণ শব্দ আমার কাছে। এই একটি শব্দের জন্য বাজি ধরতে পারি সমস্ত জীবন।’
মুহূর্তের ভুলে ব্যর্থ হয়ে যায় ক্রেইগ হত্যার আয়োজন। ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় রামকৃষ্ণ। ফাঁসির রায় হয় তার। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে, অথচ মনে কোনো ভয়–ভীতি নেই। এমন সাহসী মানুষের প্রতি কার না মন টলবে!
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির পর থেকেই প্রীতিলতা সরাসরি বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তার প্রেক্ষিতেই পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবের সদর দরজায় সাইনবোর্ড ঝুলানো ছিল, ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।’ ইউরোপিয়ান ক্লাব–এর আগেও একবার আক্রমণের পরিকল্পনা করেন মাষ্টার দা। কিন্তু সেদিন গুড ফ্রাইডে থাকায় ক্লাবে কেউ ছিল না।
প্রীতিলতার ভালোবাসার গল্প জানার কৌতূহলটা আরও বাড়ে কারণ জেলখানায় রামকৃষ্ণের বোন পরিচয় দেয়া প্রীতিলতা আর রামকৃষ্ণর গল্পের মধ্যে আমরা দেখতে পাই বিপ্লবীদের বিপ্লবযজ্ঞের ভয়ংকর সাহসিকতার এবং দুধর্ষ বিভিন্ন ঘটনা। সাধারণ কোনো প্রেমালাপ নয় কিন্তু। রামকৃষ্ণের প্রতি প্রীতিলতার এই অনুরাগের কথা অনেকেই জানতে পারে। প্রীতিলতার পিসি তাকে নিষেধও করে এভাবে যেন সে নিজে নিজে কষ্ট তৈরি না করে। কিন্তু মন কি আর এসব কথা মানে! মন তো পাগলা ঘোড়া! কখন কোথায় দেয় ছুট! প্রীতিলতার মনও মানে নি। জেলে গিয়ে রামকৃষ্ণের সাথে এতবার দেখা করেছে সে মাষ্টারদাও তা জানতেন। সেসব কথা আরও বিস্তারিত জানার জন্য মাষ্টারদা পটিয়ার ধলঘাটে বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে প্রীতিলতার সাথে সরাসরি দেখা করেন। সেখানে বিপ্লবী নেতার মধ্যে আরও ছিল নির্মল সেন, অপূর্ব সেন। সাবিত্রী দেবীর প্রতিবেশী অর্থলোভে ব্রিটিশ পুলিশের কাছে বিপ্লবীদের খবর জানিয়ে দিলে তাৎক্ষণিক আক্রমণে নির্মল সেন সেখানেই মারা যায়। মাষ্টারদা, প্রীতিলতা আর অপূর্ব সাবিত্রী দেবীর বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে মারা যায় অপূর্ব সেন।
১৭৫৭ তে নাটোরের রাণী ভবানী আর ১৮৫৭ তে ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঈ স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য জীবন দিয়েছিল। প্রীতিলতার প্রেরণা ছিল তারা। তাই তার ভাবনায় চলে আসে, ‘নাটোরের রাণী আর ঝাঁসির রাণী যা পেরেছিল চট্টগ্রামের রাণীও তা পারবে।’ প্রীতিলতাও পেরেছে। তাই তো এই বাংলায় সাহসী নারীর কথা আসলে, যোদ্ধার কথা আসলে, দেশপ্রেমিকের কথা আসলে প্রথমেই আসে প্রীতিলতার নাম।
‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ পড়ে আমার মিশ্র অনুভূতি হয়েছে। প্রীতিলতাকে এমনিতেই যতটা জানি রামকৃষ্ণকে নিয়ে প্রীতিলতার কল্পিত অনুভূতি ছাড়া বইটার মধ্যে নতুন আর তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু পেলাম না। কারণ এখন গুগল মামাকে প্রীতিলতার নামে সার্চ দিলেই এত এত গল্প বেরিয়ে আসে সেখানে এই বইটি আলাদাভাবে কোনো অনুভূতির সঞ্চার করতে পারেনি। ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে এ–জায়গায় কিছুটা ঝক্কি আছে বলা যায়। তবে উপন্যাসটা পড়তে ভালো লাগছিল। অনেক জানা কথা, বলা যায় একই কথাই যেন পড়ছিলাম, কিন্তু পড়ার মাঝখানে বইটা ছেড়ে দিতে মন সায় দিচ্ছিলো না। প্রথমেই বলেছি বইটা পড়ার আগ্রহ হয়েছিল মূলত প্রীতিলতাও ভালোবেসেছিল কাউকে, কে সেই মানুষ, কী তার গুণাগুণ এসব জানার জন্য। সে হিসেবে উপন্যাসে রামকৃষ্ণকে নিয়ে প্রীতিলতার মনের ভাবনাগুলো লেখক তার কলমের যাদুতে সুন্দরভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
কিন্তু প্রীতিলতা বলেই হয়তো কোথাও কিছু মায়া রহিয়া যায়– এর মতো কোথাও যেন কিছু বাদ রয়ে যায়। সম্পূর্ণ জানা যেন সম্ভব নয়। তাই ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ও আমার কাছে অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
প্রীতিলতা, রামকৃষ্ণরা ২০/২১ বছর বয়সে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার দীপ্ত প্রয়াসে জীবন কাটিয়েছেন এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জনে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। এই গল্পগুলো যতবার পড়ি পুরনো হয় না। বরং প্রতিবারই নতুন উদ্যমে পড়া শুরু করি। পড়তে পড়তে কল্পনার জগতে সেসময়কার চিত্রটা খুঁজি। একই শহর বলেই কিনা কে জানে মনে হয় এই তো এখানেই তো প্রীতিলতার বেড়ে ওঠা। এখানেই কেটেছে শৈশব, কৈশোর। এই পথ ধরেই তো কত হেঁটেছে প্রীতিলতা। সেই একই পথ এখনো মুখরিত হয়ে আছে নতুন মানুষের পদচারণায়…। বইটির প্রকাশক ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ।