ভালোবাসার প্যারাবনে চিংড়ি ঘের

চকরিয়া সুন্দরবনের মতো ধ্বংসের পথে উপকূলের এই প্রতিরক্ষা দেয়ালও

চকরিয়া প্রতিনিধি | শনিবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২২ at ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের বিলুপ্ত চকরিয়া সুন্দরবনে জেগে ওঠা চরে রোপিত প্যারাবন কেটে তৈরি করা হচ্ছে চিংড়ি ঘের। একই সঙ্গে চরের জমিও দখল হয়ে যাচ্ছে দেদারছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোনো ধরনের তৎপরতা না থাকায় দখলবাজরা এই অপকর্ম করে যাচ্ছে বলে উপকূলবাসীর অভিযোগ। এতে ১৯৯১ সাল পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে সৃজিত প্যারাবনও আর অবশিষ্ট থাকছে না।

সরেজমিন চকরিয়া সুন্দরবন উপকূল ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার বদরখালী, চরণদ্বীপ, চরণদ্বীপ মৌজার রামপুর, চিলখালী, গোলদিয়ার অসংখ্য শাখাপ্রশাখা খালের দুই তীরে জেগে উঠা চরে সৃজিত প্যারাবন কেটে ফেলা হয়েছে। এখন সেখানে তৈরি করা হচ্ছে চিংড়ি ঘের। আবার খালের দুই তীর দখল করে অবৈধ স্থাপনাও নির্মাণ করছে এলাকাভেদে স্থানীয় প্রভাবশালী দখলবাজরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত সময়ে উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের লম্বাঘোনা ১০০ একর চিংড়ি প্রকল্প পরিচালনা কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ও হেলাল উদ্দিন ঘেরের আয়তন বাড়াতে কয়েক হাজার গাছ কেটেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দুর্গম ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগে দিনরাত সমানে বিরল প্রজাতির কেওড়া ও বাইন গাছ কেটে চিংড়ি ঘের তৈরি করেন তারা। তবে প্যারাবন উজাড়ের অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে অভিযুক্ত নুরুল ইসলাম ও হেলাল উদ্দিন বলেন, বদরখালী সমবায় সমিতির কাছ থেকে লিজ নিয়েই তারা প্রকল্পে তারা চিংড়ি উৎপাদন করছেন। ঘেরের আশপাশে কোনো প্যারাবন ছিল না এবং প্যারাবন উজাড়ের বিষয়টিও সঠিক নয়।

প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনসংলগ্ন চকরিয়াপেকুয়ার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়। পরবর্তীতে ওআইএসসিএ ইন্টারন্যাশনাল নামক জাপানভিত্তিক একটি পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশে এসে প্যারাবন সৃজনের উদ্যোগ নেয়। যাতে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে কক্সবাজারের উপকূলবাসী বিশেষ করে চকরিয়ার উপকূলের জানমাল রক্ষা পায়।

জাপানি সংস্থাটির কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক হামিদুল হক মানিক জানান, ১৯৯১ সালে কক্সবাজারের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত হলে পরের বছর থেকে জাপানি পরিবেশবন্ধুরা এগিয়ে এসেছিলেন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া চকরিয়া সুন্দরবনের জেগে উঠা চরে প্যারাবন সৃজনে। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সংস্থার ব্যানারে প্রতিবছরই জাপানি পরিবেশবন্ধুরা এসে এখানে প্যারাবন সৃজন করে গেছেন। তিনি জানান, জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া স্বেচ্ছাসেবীরা প্রতিবছর দলে দলে এসে সুন্দরবনের বিলুপ্ত কেওড়া, গেওয়া, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির অন্তত ৪০ লাখ গাছ রোপণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় প্রভাবশালীরা তাদের সৃজিত প্যারাবনের প্রায় ১০ লাখ গাছ কেটে তৈরি করেছে কয়েকশ চিংড়ি ঘের। সাম্প্রতিক সময়েও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভূমিদস্যুরা। বর্তমানে চকরিয়ার সুন্দরবনের চরণদ্বীপ মৌজার রামপুর, চরণদ্বীপ, চিলখালী, গোলদিয়া প্যারাবনের গাছে কোপ পড়ছে দেদারছে।

জাপানের অপর সংস্থা ওয়েস্কার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের পরিচালক তাতসুয়ো কসুগি ও স্থানীয় প্রতিনিধি হামিদুল হক মানিকের তত্ত্বাবধানে চকরিয়া সুন্দরবনে কয়েক লাখ গাছ রোপণ করা হয়। প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে ওয়েস্কার স্বেচ্ছাসেবীরা এক বা একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে গাছের চারা রোপণ করতে আসতেন। স্বেচ্ছাসেবী দলে ছিলেন জাপানের বিভিন্ন কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। অবশ্য হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর গত কয়েক বছর জাপানি স্বেচ্ছাসেবীরা আসেননি। হামিদুল হক মানিক জানান, চকরিয়া সুন্দরবনের ভেতরে প্রবাহিত নদী ও খালে প্রতিবছর নতুন চর জেগে ওঠে। এসব চরেই জাপানি পরিবেশবন্ধুরা ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের উপযোগী চারা রোপণ করতেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৩১ মে ও ১৫ জুন দুই দফায় ২৭ জন জাপানি স্বেচ্ছাসেবী এসে চকরিয়া উপজেলার রামপুর ও বদরখালী মৌজায় বিলুপ্ত প্রজাতির পাঁচ হাজার কেওড়া ও বাইন গাছের চারা রোপণ করে গেছেন। স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তা করে ইলিশিয়া এলাকার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্যারাবন উজাড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাপানিদের সৃজিত প্যারাবন যখন উজাড় করা হয় তখন বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও করেছি। সেই মামলার দায় থেকে অনেকে অব্যাহতিও পেয়ে গেছেন। তারা আবার নতুন করে প্যারাবন উজাড় করে চিংড়িঘের তৈরি করছেন। যা খুবই দুঃখজনক।

প্যারাবন রক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, উপকূলের মানুষের জানমাল রক্ষায় প্যারাবন কী পরিমাণ ভূমিকা রাখে তা উপকূলের মানুষকে জানতে হবে। এই প্যারাবন যে মানুষের প্রতিরক্ষা দেওয়াল তা বুঝতে হবে। এখন থেকে প্যারাবনের একটি গাছও যাতে কাটা না পড়ে সেজন্য কঠোর নজরদারি করা হবে। প্যারাবন রক্ষায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদের আগে বেড়েছে সেমাই চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম
পরবর্তী নিবন্ধদুই মাস পর আজ রাত থেকে ইলিশ ধরা শুরু