ভারতে ২৪২ আরোহী নিয়ে বিমান বিধ্বস্ত

এই প্রথম এভাবে দুর্ঘটনায় পড়ল বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার অলৌকিকভাবে বাঁচলেন এক যাত্রী, উড্ডয়নের পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ওপর এটি ভেঙে পড়ে

আজাদী ডেস্ক | শুক্রবার , ১৩ জুন, ২০২৫ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ভারতের আহমেদাবাদ থেকে ২৪২ জন আরোহী নিয়ে লন্ডনে যাওয়ার পথে গতকাল এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান এয়ারপোর্টের কাছে আবাসিক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়েছে। সোশাল মিডিয়ায় আসা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানটি উচ্চতা বাড়াতে না পেরে খুব নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এবং কিছুক্ষণ পর সেটি ভূমিতে আছড়ে পড়ে। বিস্ফোরণের পর পরিণত হয় আগুনের গোলায়। দুর্ঘটনার আগে বিমানটি প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে উড়েছিল এবং বেলা ১টা ৩৮ মিনিটে সেটি বিধ্বস্ত হয়। এটি ভারতের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান ছিল, বিমান দুর্ঘটনায় সম্ভবত সকল আরোহীই নিহত হয়েছেন। পরে অলৌকিকভাবে একজনের বেঁচে যাওয়ার খবর আসে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বিমানটি আহমেদাবাদের একটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের ওপর আছড়ে পড়ায়। রাজ্য পুলিশের কর্মকর্তা বিধি চৌধুরী রয়টার্সকে বলেন, ‘কমপক্ষে ২৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু উড়োজাহাজটি একটি হোস্টেল ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়েছে, সেখানে থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থীও নিহত হয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘১১এ নম্বর আসনে বসা এক যাত্রীকে জীবিত পাওয়া গেছে। তিনি বিমানের জরুরি নির্গমন দরজার পাশেই ছিলেন। আরও কেউ বেঁচে আছেন কি না, সেটা আমরা হাসপাতালে খুঁজে দেখছি।’ আহমেদাবাদ পুলিশের প্রধান জিএস মল্লিক বলেন, উদ্ধার করা মরদেহগুলোর মধ্যে উড়োজাহাজের যাত্রী ছাড়াও নিচে থাকা লোকজন রয়েছেন। গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানিও রয়েছেন নিহতদের মধ্যে।

বেঁচে যাওয়া একমাত্র যাত্রীর নাম বিশ্বকুমার রমেশ। প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, বিমানটি ওড়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই গোটা ঘটনাটি ঘটেছে। একটা জোরালো শব্দ হয়। তার পরেই বিমানটি ভেঙে পড়েছিল। সংবাদমাধ্যমকে ওই যাত্রী বলেন, ‘সব কিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটেছিল, বুঝতেই পারিনি। যখন জ্ঞান ফেরে, উঠে দেখি, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে লাশ। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। উঠে দাঁড়ানোর পরেই পালাতে শুরু করেছিলাম আমি। সেই সময় কেউ একজন আমাকে ধরে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দেন। তার পর ওই অ্যাম্বুল্যান্সে করেই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

রয়টার্স লিখেছে, বিধ্বস্ত ভবনের চারপাশে ড্রিমলাইনারের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে। উড়োজাহাজের লেজ আটকে আছে ভবনের ছাদে। ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে, ভবন জুড়ে ধোঁয়া, আগুন এবং উড়োজাহাজের টুকরো অংশ।

এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছে, ফ্লাইট এআই ১৭১ এর আরোহীদের মধ্যে ২১৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক, ১১ জন শিশু এবং ২ নবজাতক ছিল। তাদের মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, ৭ জন পর্তুগিজ এবং একজন কানাডীয় নাগরিক।

ফ্লাইটরেডার টোয়েন্টিফোর জানিয়েছে, ২০১১ সালে বাণিজ্যিক ফ্লাইট শুরু করা বোয়িংয়ের ৭৮৭৮ ড্রিমলাইনার এই প্রথম বিধ্বস্ত হল। আহমেদাবাদের দুর্ঘটনার আগে বোয়িং ৭৮৭ মডেলের কোনো বিমান এভাবে ভেঙে পড়ার ঘটনা কখনো ঘটেনি। যে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটি প্রথমবার ওড়ে ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালে সেটি এয়ার ইন্ডিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়। মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে বোয়ি ৭৮৭ ড্রিমলাইনারে ১০০ কোটির বেশি যাত্রী পরিবহন সম্পন্ন করার মতো ঐতিহাসিক মাইলফলক অর্জন করে। তখন বোয়িং জানায়, তাদের তৈরি ১ হাজার ১৭৫টি ৭৮৭ ড্রিমলাইনার মডেল বিমান এখন পর্যন্ত ৫০ লাখের বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে এবং আকাশে মোট ৩ কোটি ঘণ্টা উড়েছে। আহমেদাবাদের দুর্ঘটনাটি বোয়িংয়ের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন তাদের আরেক মডেল ৭৩৭ একের পর এক দুর্ঘটনায় পড়ছে এবং কোম্পানিটি নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছে। দুর্ঘটনার খবরের পর বোয়িংয়ের শেয়ারের দর ৫ শতাংশ কমে যায়।

এয়ার ইন্ডিয়ার দুর্ঘটনাগ্রস্ত বোয়িং ৭৮৭৮ ড্রিমলাইনার বিমানটি গতকাল সকালে দিল্লি থেকে অহমদাবাদে এসেছিল। দুপুরে অহমদাবাদ থেকে লন্ডনের গ্যাটউইকের উদ্দেশে রওনা হতে না হতেই ভেঙে পড়ে সেই বিমান। গত এক সপ্তাহে ওই বিমানটি ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে ঘুরেছে।

দুর্ঘটনার আগে বিমানটি প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে উড়েছিল এবং বেলা ১টা ৩৮ মিনিটে সেটি বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনার পর আহমেদাবাদ বিমানবন্দরের কার্যক্রম কয়েক ঘণ্টা বন্ধ রাখার পর পুনরায় চালু করা হয়।

বিমানটি বিধ্বস্ত হয় আহমেদাবাদের বিজে মেডিকেল কলেজের হোস্টেল ভবনের ওপর। ওই ভবনের ডায়নিং হলে তখন দুপুরের খাবারের পর্ব চলছিল। দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায় হোস্টেল ভবনটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও চাকা ভবনের যে অংশে আটকে আছে, সেখানেই হোস্টেলের ডায়নিং হল। সারি সারি টেবিলে খাবারসহ প্লেট রাখা। তবে টেবিলগুলোতে ধুলাবালির আস্তরণ জমে আছে।

ওই মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রের মা বলেন, ‘আমার ছেলে দুপুরের হোস্টেলে ছিল। সৌভাগ্যবশত সে বেঁচে আছে, দ্বিতীয় তলা থেকে লাফ দিয়ে কিছুটা আহত হয়েছে।’ ঠিক কী কারণে উড়োজাহাজটি দুর্ঘটনায় পড়ল, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ওড়ার সময় পাখির আঘাত লাগাসহ কয়েক রকম সম্ভাবনার কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে।

এক মার্কিন বিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক রয়টার্সকে বলেন, ভিডিওতে দেখা যায়, উড্ডয়নের সময়ও বিমানের চাকা নিচে ছিল, যা স্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, যদি কেউ না জানত কী ঘটছে, তাহলে ভাবত বিমানটি অবতরণ করছে।

বৃহস্পতিবারের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ভারতের ইতিহাসে ৩৭ বছর আগে এই আহমেদাবাদেরই আরেকটি দুর্ঘটনার স্মৃতি সামনে এনেছে।

১৯৮৮ সালের সেই ঘটনায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট কুয়াশার মধ্যে আহমেদাবাদের রানওয়েতে নামতে গিয়ে পাশের একটি জলাধারে গিয়ে নামে। পাইলট বুঝতে পেরে উড়োজাহাজ আবার ওপরে তুলতে চাইলেও তখন আর সময় ছিল না। ওই ফ্লাইটের ১৩৫ জন আরোহীর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৩৩ জন।

দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে এক কোটি রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে টাটা গ্রুপ। এক বিবৃতিতে এই ঘোষণা দেন টাটা চেয়ারম্যান এন চন্দ্রশেখরণ। তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করবে টাটা গ্রুপ। একইসঙ্গে বিমান ভেঙে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মেডিকেল হোস্টেলটি পুনর্নির্মাণেও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন চন্দ্রশেখরণ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদের সম্পত্তি জব্দ
পরবর্তী নিবন্ধকোরবানির ঈদে ছাগল না দেয়ায় অপমান, গৃহবধূর আত্মহত্যা