সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে বিশেষ তদন্ত দল গঠন করেছে ভারতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এসআইটি (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম) নামের এ দল একজন আইজির নেতৃত্বে তিনজন ডিআইজি এবং বিভিন্ন পর্যায়ের ১০–১২ জন কর্মকর্তা নিয়ে গঠন করা হয়েছে। দলটি আনার হত্যার বিস্তারিত তদন্ত করবে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্ত দলটি দ্রুততার সঙ্গে প্রযুক্তিগত তথ্যপ্রমাণ ও ফরেনসিক রিপোর্ট সংগ্রহের কাজটি নিশ্চিত করবে। এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত আখতারুজ্জামান শাহীনকে ধরতে ঢাকার পুলিশ ও ইন্টারপোলের সঙ্গে সমন্বয় করবে তারা। ঢাকা ও কলকাতার পুলিশের ভাষ্য, কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে এমপি আনার খুন হওয়ার পর ঢাকা থেকে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু, সেখান থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান শাহীন। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আনার হত্যাকাণ্ডের মামলা ভারতে হয়েছে। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। কাজেই ভারত সরকারই এটা দেখবে, যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছে তাদের দেশে। খবর বিডিনিউজের।
টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, নেপালে পালিয়ে আছেন শাহীনের সহযোগী সিয়াম হোসেন। তদন্তের জন্য সিআইডির বিশেষ তদন্ত দলটি শিগগির নেপালেও যাবে। এদিকে তদন্তের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে গতকাল নেপালের কাঠমান্ডু গেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি দল। গতকাল সকালে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের দলটি ঢাকা ছাড়ে।
আনন্দবাজার পত্রিকা সিআইডির একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠনের খবর দিয়ে বলেছে, দলটি এরই মধ্যে নেপাল সীমান্তে পৌঁছে গেছে। তারা সিয়ামকে ধরার বা হাতে পাওয়ার চেষ্টা করছে। তদন্তকারীদের একটি অংশের দাবি, বাংলাদেশ পুলিশও সিয়ামকে নিজেদের হেফাজতে নিতে চাইছে। দুই পক্ষই চেষ্টা করায় ওই প্রক্রিয়া কিছুটা ধাক্কা খাচ্ছে।
সংসদ সদস্য আনার হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বাংলাদেশে তিনজন ও কলকাতায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলকাতার সিআইডি ঢাকায় এসে ও ঢাকার ডিবি কলকাতায় গিয়ে সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বাংলাদেশে গ্রেপ্তার তিনজনকে প্রথম দফায় রিমান্ড শেষে শুক্রবার আরও ৫ দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পায় ডিবি।
গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, এমপি আনার হত্যার ‘মাস্টারমাইন্ড’ তার বাল্যবন্ধু ঝিনাইদহের কোর্টচাঁদপুরের আখতারুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এ হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইঞা। গ্রেপ্তারদের বরাতে পুলিশ বলছে, এমপি আনার কলকাতায় যাওয়ার পরদিন বৈঠক করার জন্য কলকাতার অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক সঞ্জিভা গার্ডেনসে শাহীনের ভাড়া বাসায় যান। সেখানেই আসামিরা তাকে হত্যা করে। হত্যায় অংশ নেওয়া সন্দেহে গ্রেপ্তার অন্য দুজন হলেন তানভীর ভুঁইয়া (৩০) ও শিলাস্তি রহমান (২২)।
ভারত ও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আনারকে খুনের বিষয়টি নির্দিষ্ট করে জানালেও তার লাশের হদিস দিতে পারছিলেন না। তদন্তের অংশ হিসেবে কলকাতায় গিয়ে সঞ্জিভা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংকে কয়েক কেজি মাংসের টুকরা উদ্ধার করার কথা জানায় হারুনের নেতৃত্বাধীন ডিবির প্রতিনিধিদল। সেগুলোর সঙ্গে আনারের স্বজনদের ডিএনএ পরীক্ষার বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন।
টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, আনার ও শিলাস্তির মধ্যকার পুরো কথাবার্তা হাতে পেয়েছে কলকাতা সিআইডি। তাদের ধারণা, হত্যার পর আনারের ফোন থেকে যে ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ চালাচালি করেছিলেন, তিনিই সিয়াম হোসেন।
সংবাদমাধ্যমটির খবরে বলা হয়েছে, সিআইডির কাছে আরও তথ্য রয়েছে যে, চলতি বছরের প্রথম দিকে শাহীনের সহযোগী হিসেবে আরেক নারী কলকাতায় এসেছিলেন। সেই নারীকে খুঁজে বের করতে ঢাকার পুলিশকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিআইডি। শিলাস্তির সঙ্গে ওই নারী মেসেজ আদান–প্রদান করেছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
নেপালে হারুনের দল : আনার হত্যার তদন্তে নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু গেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি দল। গতকাল সকালে ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের দলটি ঢাকা ছাড়ে। রওনা হওয়ার আগে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, ইদানীং বাংলাদেশের অনেক সন্ত্রাসী কাঠমান্ডুকে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে (আনার হত্যার) যে মদদদাতা শাহীন, সেও আমরা দেখেছি যে, কাঠমান্ডুর মাটিকে ব্যবহার করে সে অন্য দেশে চলে গেছে। আরও অন্যান্য আসামি সম্পর্কে কিন্তু আমরা এই রকম তথ্য পাচ্ছি। এছাড়া আগেও অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে আমরা দেখেছি ওইখানে থাকে। তদন্তের কাজেই মূলত আমরা কাঠমান্ডু যাচ্ছি। তদন্তে আমরা নেপাল পুলিশের সহযোগিতা চাই। এ রকম অনেক আসামি তারা কাঠমান্ডুকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে, সেখানে থাকে। এ সকল তথ্য কালেকশন করা, তারপরে কাঠমান্ডু পুলিশের সাথে যোগসূত্র এবং ইন্টারেকশন করা, যাতে ভবিষতে কোনো আসামি বাংলাদেশে অপরাধ করে সেখানে ঠাঁই না পায়।
আনার হত্যা মামলা ভারতে, তারাই দেখবে : সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত ফিরিয়ে আনবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের মামলা ভারতে হয়েছে। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। কাজেই ভারত সরকারই এটা দেখবে, যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছে তাদের দেশে। যেখানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, মূল মামলার তদন্ত তারাই করবেন। সেখানে যদি আমাদের সম্পৃক্ত করে আমরা সহযোগিতা করব।
গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, নেপালে একজন পালিয়ে গেছে। যে যেখানে আছে, তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। একজন সংসদ সদস্যকে এ রকম নৃশংসভাবে হত্যা করবে, আর আমরা বসে থাকব এটা তো হতে পারে না। আমাদের সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে, যারা এই খুন করেছে বা খুনে সহযোগিতা করেছে, তদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। নেপালে যে আছে, তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা সেটা আমরা করছি।
ঝিনাইদহ–৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে উঠেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। এরপর স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। ২২ মে সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নিউ টাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পুলিশের বরাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।