৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে নির্বাচনের পর এবছর ৮ ফ্রেরুয়ারি পাকিস্তানে এবং মে মাসে ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ভারতের দীর্ঘদিনের গ্রহণযোগ্য ও প্রতিষ্ঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা বর্তমান ধর্মান্ধ, সাম্রদায়িক, লুটেরা পুঁজির সহযোগী শাসকগোষ্ঠী কৌশলে দুর্বল করে ক্ষমতা স্থায়ী করতে চাইছে। পাকিস্তানের সদ্য সাবেক কারান্তরীণ প্রধান মন্ত্রী ইমরান খান তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য দেশের সামরিকবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ি করেছেন যদিও ঐ দুই শক্তিই তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে প্রান্তিক অবস্থান থেকে ক্ষমতায় এনেছিল। জন্মের পর থেকেই সামরিকবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাতেই গত ৭৫ বছর ধরে পাকিস্তানের ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতিই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিন দেশেই প্রচলিত প্রচন্ড শক্তিশালী হয়ে ওঠা লুটেরা বাজার অর্থনীতিই অবাধ ও নিরেপেক্ষ নির্বাচন ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। কৌতূহলের বিষয় হল তিন দেশেই ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো মুখে যাই বলুক তারা কিন্তু অভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি আদর্শে বিশ্বাসী। এক্ষেত্রে ভারতের নেতিবাচক পরিবর্তনের প্রভাব পুরো অঞ্চলের পরে বলে আমাদের তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হয়।
আসন্ন ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারতীয় গণতন্ত্র আরো অনিশ্চিত অধোগতির দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। একের পর এক ঘটে চলেছে অভাবিত সব ঘটনা। কয়েকদিন আগে সুরক্ষিত নব নির্মিত লোকসভা ভবনে অধিবেশন চলাকালীন দু’জন অচেনা যুবক সংসদ কক্ষে প্রবেশ করে রঙিন ধোঁয়ার কুন্ডলী ছড়িয়ে দেয়। আতংকিত সংসদ সদস্যরা কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উপস্থিত বিরোধী দলীয় সদস্যরা ন্যায়সঙ্গতভাবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবী করে বিক্ষোভ করেন লোকসভা ও রাজ্যসভায়। সরকার কোন বিবৃতি না দিয়ে উল্টো বিক্ষোভের মুখে লোকসভা ও রাজ্যসভার বিরোধী বিভিন্ন দলের প্রায় দেড় শতাধিক সদস্যকে এক সাথে সাসপেন্ড করেন এবং সেই বিরোধীদল শূন্য অধিবেশনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল আলোচনা ছাড়াই পাশ করিয়ে নেন– যার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হল সুপ্রীম কোর্টের এক্তিয়ার থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ফিরিয়ে নেয়া। এই বিল পাশের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি বিরোধীদলের শূন্য আসনগুলোর প্রতি আঙ্গুল উঁচিয়ে ফ্যাসিস্ট কায়দায় বলেন যে এই আসনগুলো ভবিষ্যতে বিজেপি সদস্যদের দ্বারা পূরণ করা হবে। লোকসভার বর্তমান অধিবেশনে নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কুক্ষিগত করতেই যেন পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়ে প্রতিবাদী বিরোধীদের সাসপেন্ড করে নির্বিবাদে ঐ বিল পাশ করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এইভাবে বিচিত্র ও বিশাল ভারতের ঐক্য ও সংহতির প্রাণ ভোমরা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত নির্বাচন ব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু হলো।ক্ষুধা, সীমাহীন বেকারত্ব ও অসহনীয় মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভারতব্যাপী ব্যাপক উন্মত্ত প্রচারণা শুরু করা হয়েছে অযোধ্যায় বহু কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাম মন্দির উদ্বোধনকে সামনে রেখে। বারাণসী ও মথুরায় আরো দুটি মসজিদ নিয়ে মৌলবাদীদের দাবীতে আদালতের নির্দেশে জরিপ কাজ চলছে। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে এ যেন এক রূঢ় মূঢ়তার বিপন্ন বিস্ময়। মূঢ় মত্ততার বিপজ্জনক আধিপত্যে নিপতিত আজ ভারত। কংগ্রেস এবং সেকুলার আঞ্চলিক দলগুলোর ক্ষমাহীন ব্যর্থতা, নিস্পৃহতা, অনৈক্য মোদিকে এই আপাত সাফল্য এনে দিয়েছে এবং ক্ষমতার অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত করেছে। সংঘ পরিবারের ভাবশিষ্য, গুজরাটের নির্মম ঘটনার নায়ক সর্বার্থভাবেই ভারতকে এক সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত হিংসার পিচ্ছিল পথে নিয়ে যাচ্ছে।
সবধর্মের মানুষের আইনি অধিকারের সর্বজনীন আশ্রয় লোকসভার নব নির্মিত ভবন রাষ্ট্রপতিকে বাদ দিয়ে প্রধান মন্ত্রী মোদি নিজেই উদ্বোধন করেন মুর্খ, ধর্মান্ধ কিছু সন্ন্যাসী পরিবৃত আভূমি সাষ্টাঙ্গেঁ প্রণাম করে যা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচার করা হল সারা ভারতে বিশাল বিশাল পর্দা খাটিয়ে। এভাবে মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ বিজেপি ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা ভারতে। আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে ভোটের সমীকরণে মমতার মুসলিম মৌলবাদ তোষণ ও এরি প্রশ্রয়ে সমাজ জীবনে ধর্মান্ধ কিছু মুসলিমের উগ্র বাড়াবাড়ির ও তার বিপরীতে ক্ষুব্ধ হিন্দুদের মধ্যে বিজেপি নানা অপপ্রচার করে ইসলামফোবিয়ার ভীতি জাগিয়ে দ্রুত স্থান করে নিচ্ছে। এইভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘদিনের অসাম্প্রদায়িক উদার সমাজ মানসকে মমতার আমলে সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভক্ত ও পশ্চিমবঙ্গকে এক অধঃপতিত রাজ্যে পরিণত করা হয়েছে। তৃণমূল মন্ত্রীদের ব্যাপক দুর্নীতি, ব্যভিচার সেই সমাজ জীবনের এক নিকৃষ্টতম বহিঃপ্রকাশ। ইতোমধ্যে অবশ্য ভারতকে কংগ্রেস শূণ্য আর পশ্চিমবঙ্গকে বামশূন্য করার মোদি–মমতার দ্বৈত ফ্যাসিবাদী স্বপ্নের ঘোর কেটে যেতে শুরু করেছে। বামরা দীর্ঘ শাসনে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের নানা রাজনৈতিক সংকটে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে কিন্তু ভোটের জন্য মমতার মত ইসলামী মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি নির্বিচার ও মাত্রাহীনভাবে। যদিও মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন ও তসলিমা নাসরিন প্রশ্নে মুসলিম মৌলবাদীদের সহিংসতা দৃঢতার সাথে মোকাবেলা না করা ছিল বামদের অনৈতিক অপরাধ।
বাম শাসন থেকে পরিবর্তন প্রত্যাশী অর্পনা সেন, কবি জয় গোম্বামী প্রমুখ সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অধ:পতিত আজকের পশ্চিমবঙ্গকে কিভাবে দেখেন জানতে ইচ্ছে করে। শিল্পবঞ্চিত সিঙ্গুঁর–নন্দীগ্রামের মানুষ আজ কি বলে ? বুদ্ধদেবের মত পরিপূর্ণ নির্লোভ, নিবেদিত রাজনীতিবিদ সংস্কৃতিবান একজন নেতাকে খাটো করে দেখলেন তাঁরা। ক্ষমতা সবসময় কিছু আবর্জনা, কিছু অনৈতিকতার জন্ম দেয়। বাম জমানার শেষের দিকে তৃণমূল পর্যায়ে বাম শক্তি এ থেকে মুক্ত ছিল না। কিন্তু নেতৃত্বের সততা ও আন্তরিকতা শেষ কথা বলে। একই ভাবে বিশাল ভারতের সাধারণের জীবনের বহুমুখী নৈমিত্তিক সমস্যা মোদির মত একজন বৃহৎ কর্পোরেট ক্যাপিটেলের বিশ্বস্ত সেবক, সাবেক সংঘকর্মী, মনে প্রাণে বিভেদে বিশ্বাসী একজন মানুষ পূরণ করবে, পরিবর্তন করবে তা তো যে কোন সমাজ ও ইতিহাস সচেতন মানুষের কষ্ট কল্পনায়ও আনা যায় না। তিনি তো দাঁড়িয়ে আছেন ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসক কংগ্রেসের তৈরি আধুনিক ভারতের বিশাল শিল্প ও অবকাঠামোগত ভিত্তির উপর মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার কালো চশমা পরে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে হিরো সাজার বাসনায় পুলওয়ারা ঘটনা ও পাকিস্তানে কথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রচারণা চালিয়ে, মানুষের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা তৈরি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হন। অথচ এই পাকিস্তানকে এক মাত্র কংগ্রেস সরকারই ১৯৪৮, ’৬৫ ও ’৭১ এ পরপর তিনটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরাস্ত করে। ’৭১ সালে ইন্দিরার সাহসী ভূমিকার ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শুধু পাকিস্তান নয় চীন–মার্কিন ষড়যন্ত্র নস্যাত হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান মোদিকে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নিঃসন্দেহে সহায়তা করেছে। সেকুলারিজম বা ইহজাগতিক চিন্তা, সামাজিক সম্প্রীতি, বিজ্ঞান মনস্কতা, সমাজের প্রগতিশীল রূপান্তর এই তিন দেশের শাসক গোষ্ঠীর কাছেই আজ অবাঞ্চিত। নয়া উপনিবেশিক শাসন শোষণের নবতর রূপ ’৭০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশকৃত মুক্ত বাজার অর্থনীতি পোশাকী নামে “নিউ–লিবারেল অর্থনীতি” এই উপমহাদেশ সহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই অনুসৃত হচ্ছে। যার মূল কথা সংক্ষেপে DLP– ডিরেগুলেজাইশন, লিবারেলাইজেশন ও প্রাইভেটাইজেশন। অর্থনীতিতে এই নীতি প্রয়োগ করে ব্যাপক লুটপাট ভারতে আজ প্রকট মাত্রা লাভ করেছে। অর্থনীতির এই ডিরেগুলাইজেশন সমাজ ও রাজনীতিকে মারাত্মকভাবে ডিরেগুলেজাইস করে দিয়েছে যার ফলশ্রুতি হলো ধর্ম নিয়ে বিভেদের, জবরদস্তি ও দখল বেদখলের রাজনীতির আজকের এই উৎকট রূপ।
ভারতের সদ্য গঠিত সাংবিধানিক আদর্শ তথা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বিরোধীদলীয় জোট “ইন্ডিয়া–কে” এ মুহূর্তে সংহত ও দৃঢ় ভিত্তির উপর ঐক্যবদ্ধ করার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তম দল হিসাবে কংগ্রেসের ত্যাগী, আন্তরিকতা ও আত্মম্ভরিতা বিহীন ঐক্য প্রচেষ্টা, নমনীয়তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও দৃশ্যমান হতে হবে। বৃহৎ দল হিসাবে স্বাধীনতার তথা গান্ধী নেহেরুর আদর্শ ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ ও প্রতিশ্রুতি তাদের থাকতে হবে। ফ্যাসিস্ট ও গণতন্ত্র বিরোধী ধর্মান্ধতার যে জগদ্দল পাথর আজ বিভ্রান্ত ভারতবাসীর ওপর চেপে বসেছে তা অপসারণের জন্য বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে এমনকি পছন্দ না হলেও বিরোধীদের বিতর্কিত দাবিকেও বিবেচনায় নিয়ে কংগ্রেসকে ধৈর্য্য ধরে এগুতে হবে। বামদের এই ঐক্য রক্ষায় সর্বাত্মক উদ্যোগী হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বহুত্ববাদী ভারতীয় আদর্শকে বাম ও কংগ্রেসকেই রক্ষা করতে হবে। নেহেরুর সূচিত সংসদীয় গণতন্ত্রের শুকিয়ে পড়া স্রোতস্বিনিকে বেগবান করতে হবে মানব কল্যাণের নির্ঝরের স্রোতধারায়। একাদিক্রমে ‘৫২ থেকে ‘৭২ সাল পর্যন্ত এমনকি এর পরেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্নে ভারতীয় লোকসভা যেমন শাসক কংগ্রেস আর প্রাজ্ঞ কমিউনিষ্ট নেতাদের তর্কে বিতর্কে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত তেমনি ভাবে আজ বিজেপির অনর্থক মধ্য যুগীয় মন্দির–মসজিদ বির্তক বাদ দিয়ে মানুষের ইহজাগতিক সমস্যা নিয়ে তর্কে বিতর্কে কর্ম চঞ্চল হয়ে উঠুক লোকসভা, ভারত ফিরে পাক তার বৈচিত্রের মধ্যে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের ঐক্য। “জনগণ মঙ্গল বিধায়ক ভারত ভাগ্য বিধাতা”‘র’ উত্থানে জেগে উঠুক উপমহাদেশ, কেটে যাক সব শঙ্কা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট