ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কড়া জবাব পাকিস্তানের

দুই দেশে নিহত ৪৬ ম ২৪টি হামলায় ৯টি ‘সন্ত্রাসী আস্তানা’ ধ্বংস করার দাবি দিল্লির ভারতের ৫টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি ইসলামাবাদের প্রথমবারের মতো কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে রাফালের ক্ষতির খবর সামনে এলো

আজাদী ডেস্ক | বৃহস্পতিবার , ৮ মে, ২০২৫ at ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ

কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার জের ধরে দুই দেশে চলমান উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। পাকিস্তানও এর কড়া জবাব দিয়ে দাবি করেছে, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। গতকাল এক ভিডিও বিবৃতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমানের মধ্যে তিনটি রাফাল, একটি সু৩০ এবং একটি মিগ২৯ এবং একটি হেরন ড্রোন গুলি করে নামানো হয়েছে।’ দিল্লি এখনো বিমান ভূপাতিত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেনি। তবে ভারতীয় একটি রাফাল যুদ্ধবিমানকে পাকিস্তান ভূপাতিত করেছেএমন খবর জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন। ফ্রান্সের এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রথমবারের মত কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে ফরাসি প্রযুক্তির এই রাফাল যুদ্ধবিমানের ক্ষয়ক্ষতির খবর সামনে এলো। ফরাসি ওই কর্মকর্তা সিএনএনকে আরও জানান, পাকিস্তান একাধিক রাফাল ভূপাতিত করেছে কিনা, তা নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। প্রসঙ্গত, ভারতীয় বিমান বাহিনীতে আছে ৩৬টি রাফাল জেট। যা কিনতে প্রায় ৭.৮৭ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে ভারত। এই হিসাবে প্রতিটি জেটের দাম পড়েছে ২১৫ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ইউরো।

হামলা পাল্টা হামলায় দুদেশে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৪৬ জন। গতরাতে বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, ভারতের বিমান হামলা ও সীমান্তে পাল্টা গোলা বর্ষণে তাদের অন্তত ৩১ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ। অন্যদিকে কাশ্মীর সীমান্তে পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৫ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানে প্রায় সাড়ে পাঁচশ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। পাকিস্তানে বাণিজ্যিক ফ্লাইটের ১৬ শতাংশ এবং ভারতের প্রায় ৩ শতাংশ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে বলে ফ্লাইট ট্র্যাকিং সার্ভিস ফ্লাইটরাডার২৪ জানিয়েছে।

দিল্লি বলেছে, তারা পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ৯টি স্থানে ‘নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক ও পরিমিত’ হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তান তাদের ভূখণ্ডে ৬টি স্থানে হামলার কথা স্বীকার করেছে। তারা এ ঘটনাকে বর্ণনা করেছে কাপুরুষোচিত হামলা হিসেবে। জানিয়েছে, উপযুক্ত সময় ও স্থান বেছে নিয়ে এই হামলার জবাব দেওয়া হবে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আহমেদ শরীফ বিবিসিকে বলেন, হামলার আঘাতে একাধিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে মসজিদও রয়েছে।

দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাতের ইতিহাস আছে। তার মধ্যে আবার নতুন করে এই সংঘাত ভারতপাকিস্তানকে সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্ব পাচ্ছে দুই দেশের এই সংঘাত। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় গোটা বিশ্বের নজরও এখন সেদিকে।

পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার বদলায় মঙ্গলবার রাতে ভারত যে হামলা চালিয়েছে তার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’। এটা স্থায়ী ছিল ২৫ মিনিট। দিল্লির দাবিএ সময়ের মধ্যে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ৯ সন্ত্রাসী আস্তানায় ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ে, যাতে অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে।

ভারতের ভাষ্য, এই হামলা স্থায়ী ছিল স্থানীয় সময় রাত ১টা ৫ থেকে দেড়টা পর্যন্ত। ভারতের বিমান, নৌ ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে এ হামলা চালিয়েছে। এনডিটিভি জানায়, গতকাল বুধবার সকালে নয়া দিল্লিতে সংবাদ ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এবং কর্নেল সোফিয়া কোরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং এসব তথ্য দিয়েছেন। তারা বলছেন, এই অভিযান ছিল ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার ‘পরিমিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ’ জবাব। পেহেলগামে সেদিনের হামলায় এক নেপালি নাগরিকসহ ২৬ জন নিহত হয়েছিল, আহত হয়েছিল অনেকে। ভারত বলছে, মঙ্গলবার রাতে মোট ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে মুজাফ্‌ফরাবাদ, কোটলি, বাহাওয়ালপুর, রাওয়ালকোট, চাকসওয়াড়ি, ভিম্বার, নীলম ভ্যালি, ঝেলাম ও চকওয়ালে।

এর জবাবে ভারতে পাকিস্তানের হামলা অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞদের বেশিরভাগই। ভারতের হামলা নিয়ে গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। ভারত পাকিস্তানের ওপর হামলা চালিয়ে ‘ভুল করেছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর মূল্য দিতে হবে তাদের। ভারত হয়তো ভেবেছিল পাকিস্তান পিছু হটবে, কিন্তু ভারত ভুলে গেছে যে এটি এমন একটি জাতি যারা তাদের দেশের জন্য লড়াই করতে জানে।’ ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করার দাবির প্রতি ইঙ্গিত করে শাহবাজ শরীফ বলেন, পাকিস্তানের বিমান বাহিনী প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে এবং ‘আমাদের পক্ষ থেকে তাদের জবাব দেওয়া হয়েছে।’ পাকিস্তান এবং পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে ভারতীয় হামলায় নিহতদের মধ্যে সাত বছর বয়সী একটি ছেলে শিশু রয়েছে বলেও ভাষণে উল্লেখ করেন শাহবাজ শরীফ। তিনি বলেন, ‘সাত বছর বয়সী একটি ছেলে যখন নিহত হয় তখন তার মা এবং ভাইয়ের সাথে বাড়িতে ছিল। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে আমরা এই নিহতদের প্রতিটি রক্তের ফোঁটার প্রতিশোধ নেব। গত মাসে পেহেলগাম হামলা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কিত ছিল না এবং দেশটিকে ভুল কারণে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমাদের অনুরোধ না রাখা বা উপেক্ষার অভিযোগ তোলার আগে ভারতের প্রতি আমরা তদন্তের দাবি জানিয়েছিলাম।’

এদিকে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সভার পর দেওয়া এক বিবৃতিতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতের হামলার কড়া নিন্দা জানিয়ে একে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ অ্যাখ্যা দিয়েছে ইসলামাবাদ। এতে বলা হয়, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে বেসামরিক নাগরিক, বিশেষ করে নিরীহ নারী ও শিশুদের লক্ষ্য করে যে হামলা চালিয়েছে তা একটি ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক অপরাধ, এটি মানব আচরণের সমস্ত নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করেছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে বুধবার পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিষয়ক এ শীর্ষ কমিটির বৈঠকে দেশটির জয়েন্ট চিফস অব স্টাফসের চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামসাদ মির্জা, গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মহাপরিচালক আসিম মুনির ও বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্তারা উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছে ডন।

অপরদিকে পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআরের মহাপরিচালক জেনারেল আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, বুধবার প্রথম প্রহরে পাকিস্তানে হামলা চালালেও ভারতের কোনো বিমানই পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ঢুকতে পারেনি, পাকিস্তানের কোনো বিমানও ভারতের ভূখণ্ডে যায়নি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর ‘আগ্রাসনের সমুচিত জবাব’ দিয়েছে এবং বেশ কয়েকটি ভারতীয় তল্লাশী চৌকি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।

ভারতের সেনাবাহিনী কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে চুড়হা কমপ্লেঙে সাদা পতাকা উত্তোলন করেছেএমন দাবি করে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেছেন, সাদা পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ভারত তাদের ‘পরাজয় স্বীকার’ করে নিয়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ওই এলাকাটিতে পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর পোস্টগুলোর উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি করেছে বলে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।

এদিকে অপর এক খবরে বলা হয়, ভারতের হামলায় জইশমুহাম্মদের প্রধান মাসুদ আজহারের ১০ আত্মীয় নিহত হয়েছে। একই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে তার চার সহযোগী। বিবিসি লিখেছে, পাঞ্জাবের বাহাওয়ালপুরে ‘সুবহান আল্লাহ’ মসজিদে এ ঘটনা ঘটে। জইশমুহাম্মদ বুধবার এক বিবৃতিতে বলেছে, নিহতদের মধ্যে আজহারের বড় বোন ও তার স্বামী, ভাগ্নে ও তার স্ত্রী, এক ভাতিজি এবং পরিবারের পাঁচ শিশুও রয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, হামলায় আজহারের তিনজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং তাদের একজনের মা মারা গেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতারুণ্যের সেমিনার-সমাবেশ ঘিরে উৎসবের আমেজ
পরবর্তী নিবন্ধঅভিযানের তথ্য পাচারের অভিযোগে সেনাবাহিনীর হাতে আটক ৪