বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, পুরো পৃথিবী আজকে বাংলাদেশের প্রশংসা করে। কিন্তু আমাদের দেশের বিরোধী দলের রাজনীতিবিদরা দেখেও দেখে না, শোনেও শোনে না। তারা ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে গিয়ে বলে কোনো উন্নয়ন হয়নি। পদ্মাসেতু দিয়ে ওপাড়ে পার হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতায় বলে কিছুই হয় নাই। এটিই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য।
গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে বাংলাদেশে সফররত ভারতীয় সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের সাথে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব এই মতবিনিয়ম সভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশীষ সুর, সাধারণ সম্পাদক কিংসুক প্রামাণিক, আসামের সিনিয়র সাংবাদিক মনোজ কুমার গোস্বামী। কাঁটাতারের বেড়া ভারত–বাংলাদেশের বন্ধনকে বিভক্ত করতে পারেনি মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমরা দু’ দেশের নাগরিক বটে, কিন্তু আমরা একই পাখির কলতান শুনি, একই নদীর অববাহিকায় আমরা বেড়ে উঠি। একই মেঘ আমাদের এখানে বর্ষণ করে। কাঁটাতারের বেড়া আমাদের এই বন্ধনকে বিভক্ত করতে পারেনি। কাঁটাতারের বেড়া আমাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য কৃষ্টি ভাষা, সবশেষে আমাদের ভালোবাসাকে বিভক্ত করতে পারেনি।
তিনি বলেন, হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের এই আত্মিক সম্পর্ক রক্তের বন্ধনে একাত্ম হয়েছে একাত্তর সালে। যখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর সাথে ভারতের সেনাবাহিনী রক্ত ঝরিয়েছে। আমাদের কষ্টের সাথে ভারতের মানুষও কষ্ট স্বীকার করেছে। এক কোটির বেশি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। যতই কাঁটাতারের বেড়া দিক, কিংবা অন্য কোনও আইন–কানুন হোক না কেন, রক্তের অক্ষরে লেখা হৃদয়ের এই বন্ধন কখনো বিভক্ত করা যাবে না।
হাছান মাহমুদ বলেন, ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সফর দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করবে শুধু নয়, মানুষে মানুষে আত্মিক সম্পর্ক আরো গভীরতর করতে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে তিনি বলেন, এখন আর আকাশ থেকে কুড়ে ঘর দেখা যায় না, বাস্তবিক অর্থে কুড়ে ঘর হারিয়ে গেছে, এটিই বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। আমাদের এই বদলে যাওয়ার পেছনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে গত ১৪ বছর ধরে আমাদের যে সুসম্পর্ক তা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং ভারতের মান্যবর প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। সেই গভীর সম্পর্ক আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তিনি বলেন, আজকে যে ছেলেটি ১৪ বছর আগে বিদেশ গেছে সে এসে নিজের শহর চিনতে পারে না, নিজের গ্রাম চিনতে পারে না। ‘পায়ে চলা মেঠোপথ গেছে বহুদূর, রাখালি বাঁশির সুর সরল মধুর’ সেটি শুধু কবিতায় আছে, এখন সহজে পায়ে চলা মেঠোপথ গ্রামেও খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার গল্প তুলে ধরতে ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে হাছান মাহমুদ বলেন, সাংবাদিকরা সমাজের তৃতীয় নয়ন খুলে দেয়, মানুষের আত্মিক খোরাক জাগায়, অনুন্মোচিত বিষয়কে উন্মোচিত করে। সমাজ এবং রাষ্ট্রকে সঠিক পথে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা ভূমিকা রাখেন। এখান থেকে গিয়ে যখন আপনারা কলম ধরবেন কিংবা টেলিভিশনে রিপোর্টিং হবে তখন দুই দেশের সম্পর্ক আরো গভীরতর হবে। আমাদের দেশের বদলে যাবার গল্পটা ভারতবাসী জানবে, বিশ্ববাসী জানবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ। আমরা মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে চতুর্থ, ধান উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে সপ্তম। কিন্তু আয়তনের দিক দিয়ে পৃথিবীতে ৯২তম। ঝড় বন্যা জলোচ্ছ্বাসের দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এখানে নিত্যসঙ্গী। কিন্তু সবকিছুকে পরাভূত করে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উপড়ে ফেলে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজকে উন্নয়নের সোপানে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি।
সালাহ্উদ্দিন মো. রেজা বলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের নাড়ির সম্পর্ক। আজকের এ আয়োজন এই সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করবে।
কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশীষ সুর বলেন, উপমহাদেশে চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। অখণ্ড ভারত গঠন আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভূমিকা অন্যতম।
তিনি বলেন, অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের অবদান সবার জানা। সূর্য সেন, প্রীতিলতার জন্মভূমি এই চট্টগ্রাম। আজ সেই তীর্থভূমি আমরা স্পর্শ করলাম। কোনো কাঁটাতার আমাদের আলাদা করতে পারেনি।
ভারতীয় সাংবাদিক মনোজ কুমার গোস্বামী বলেন, চট্টগ্রামের সংস্কৃতির সঙ্গে আসামের অনেক যোগাযোগ আছে। আসামের সঙ্গে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক সর্ম্পকের উন্নয়নেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। দু’দেশের মেলবন্ধন কখনো বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ শাহরিয়ারের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আলী আব্বাস, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি শহীদুল আলম, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি তপন চক্রবর্তী সাধারণ সম্পাদক ম শামসুল ইসলাম, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহ–সভাপতি চৌধুরী ফরিদ।
জানা গেছে, তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে কলকাতা থেকে ২৫ জন এবং আসাম ও গৌহাটি থেকে ৯ জন সাংবাদিক ৬ থেকে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফরের অংশ হিসেবে গতকাল চট্টগ্রাম আসেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে মতবিনিময় সভার আগে ড. হাছান মাহমুদ ভারতীয় সাংবাদিকদের নিয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেল ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মাহুতির স্থান পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাব পরিদর্শন করেন। বিকেলে সফররত সাংবাদিকদল বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র ও বাটালি হিল পরিদর্শন করে।
বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার ডা. রাজীব রঞ্জন, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটি এম পেয়ারুল ইসলাম, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম, বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএম মাহফুজা আক্তার, সিনিয়র তথ্য অফিসার মারুফা রহমান ঈমা, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, সাবেক সভাপতি আলী আব্বাস।
কর্ণফুলী টানেল পরিদর্শনকালে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী ভারতীয় সাংবাদিকদের জানান, কর্ণফুলী টানেলের শতকরা ৯৫ দশমিক ৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের কার্যক্রম। সব কাজ শেষে আগামী মার্চ নাগাদ টানেলটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা যাবে। এ সময় বিস্ময় প্রকাশ করে ভারতীয় সাংবাদিকরা বলেন, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ যে বহুদূর এগিয়ে গেছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তারা বলেন, কলকাতায় মেট্রোর জন্য ছোট আকারের একটি টানেল থাকলেও কর্ণফুলীর মতো এতোবড় টানেল নেই।
পরে সাংবাদিক দল কর্ণফুলীর নদীর তীর ঘেঁষে নির্মিত সুদৃশ্য মেরিন ড্রাইভ ও চলমান বে– টার্মিনালের নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করেন। এসব উন্নয়ন কার্যক্রম দেখে প্রতিনিধিদলের সাংবাদিকরা বিস্ময়ে অভিভূত হন।
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব পরিদর্শনকালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা প্রীতিলতার স্মৃতির প্রতি তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ভারতীয় সাংবাদিকরা বলেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রামবাসী বেশি অবদান রেখেছে। আগামীতেও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে চট্টগ্রামবাসীর ভূমিকা সবার আগে থাকবে। চট্টগ্রাম বাংলাদেশকে পথ দেখাবে।