আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান কোনোভাবেই যাতে ব্যর্থ না হয় সেজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশকে একটা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন, সার্বভৌম ও গর্বিত জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। যে অর্থে ছেলেরা আত্মদান (শহিদ) করেছেন, যে অর্থে আত্মদান করেছেন সাধারণ মানুষ। আমরা যখন চলে যাবো, আমাদের মনে যেন আফসোস না থাকে, যে দায়িত্বটা নিয়েছি কাজটা করি নাই। সেজন্যই সবাই দোয়া করবেন। সবাই যেন একসাথে থাকি এবং যারা আত্মহুতি দিয়েছেন, আহত হয়েছেন তাদের আত্মদানকে মূল্যায়ন করতে পারি। আইন উপদেষ্টা গতকাল শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘স্মৃতির মিনার : গণভ্যুত্থান ২০২৪’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের একশ দিন পূর্তি ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ ছাত্র–জনতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এই সভার আয়োজন করে।
আসিফ নজরুল বলেন, আমরা যদি নিজেরা নিজেরা ঝগড়া ঝাটি করি, কুৎসা রটাই, চরিত্র হনন করি, মিথ্যা তথ্য দেই তাহলে তো আমাদের ছাত্র জনতার যে আত্মবলিদান তার প্রতি অশ্রদ্ধা জানানো হবে। কারো প্রতি অভিযোগ না, সবার প্রতি অনুরোধ প্লিজ সত্য জানার চেষ্টা করুন। এই মিথ্যা দোষারোপ পরাজিত ফ্যাসিস্টদের অস্ত্র ছিল। সেটা কেন আমরা বহন করবো। আমাদের অস্ত্র থাকবে সত্য ও ঐক্য। শোষণ ও বৈষম্য মুক্ত। তিনি বলেন, আমাদের কাজের সমালোচনা করবেন ঠিক আছে। যখন ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করবেন তখন মনে হয় সমালোচনাটা অসৎ উদ্দেশ্যে করা, এই সরকারকে শক্তিহীন করা। আন্দোলনকারী মানুষের মাঝে অনৈক্য নিয়ে আসা, দেশকে অস্থিতিশীল করা, পরাজিত শক্তির হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার জন্য এগুলো করা হচ্ছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আমাদের একটি প্রতিবেশী দেশের স্ক্রিপ্ট আছে না? শেখ হাসিনা চলে গেলে দেশ আর কেউ চালাতে পারবে না। অথবা দেশ উগ্রবাদীদের খপ্পরে পড়বে। তার (শেখ হাসিনার) কোনো বিকল্প নেই। ওই ভারতীয় স্ক্রিপ্ট এখানে রূপায়িত করার কাজে নেমেছে কিছু মানুষ। না হলে তাদের কি স্বার্থ? বিগত প্রায় ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার কি করেছে? আমাদের পরামর্শ দেন আমরা কি করবো। আসিফ নজরুল বলেন, আমাদেরকে যদি আরও সমর্থন করেন, ঠিক মত গাইড করেন। এই সরকার যদি সফল হয়। তবেই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করতে পারব। জুলাই–আগস্টে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের আত্মদানের মিনিমাম একটা মূল্যায়ন করতে পারবো। তাদের প্রত্যাশাকে এগিয়ে নিতে পারবো।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম, লেখক ও সম্পাদক রাখাল রাহা, কবি ও একটিভিস্ট ফেরদৌস আরা রুমী, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বিশেষ প্রতিনিধি ও পরিচালনা পরিষদের পরিচালক মো. ফজলুল হক ও নূরে আলম মাসুদ, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বাসস’র বিশেষ প্রতিনিধি দিদারুল আলম।
আসিফ নজরুল বলেন, খুবই দুঃখ ও অবাক লাগে যখন দেখি আজগুবি, ভিত্তিহীন, অকল্পনীয় তথ্য দিয়ে একজন আরেকজনের পেছনে লেগে আছে। একটা ভিডিওতে নাকি দাবি করা হয়েছে আগস্টের ৩–৪ তারিখ রাতে আমি ক্যান্টনমেন্টে (সেনানিবাসে) ছিলাম। সেখানে আর্মি অফিসারদের নিয়ে ভারতের দালালদের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমি অবাক হয়ে যাই। মানুষের কল্পনারও একটা সীমা থাকা উচিত।
তিনি বলেন, ৩ আগস্ট রাতে মাহবুব মোর্শেদ (বর্তমানে বাসসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক) সহ অন্যদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে রাত ৯টা পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফুলার রোডের আবাসিক ভবনে এক শিক্ষকের বাসায় রাতে থেকেছি। আশঙ্কা ছিল, আমাকে মেরে ফেলবে, না হলে গ্রেপ্তার করবে। আর ৪ আগস্ট সন্ধ্যার পরে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের একটি প্রোগ্রামে আমি অংশ নিয়েছি। যার অডিও আপনারা অনেকেই শুনেছেন। যেখানে আমি বলেছিলাম, আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারে। কারণ, সবাই আমাদেরকে বলেছে পালিয়ে যেতে। তারপর সেদিন রাতেও ঢাবির ওই শিক্ষকের বাসায় ছিলাম। সবকিছুর একটা সীমা আছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকবে। আমরা একজন আরেকজনের কাজের সমালোচনা করব। কিন্তু মিথ্যা কথা কেন বলব? মানুষজন আমাকে বলে আপনি ক্লিয়ার করেন (অভিযোগের বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দেন)। আমি বলি, আমি কি ক্লিয়ার করব? সত্যের কাছাকাছি থাকলে মানুষ প্রতিবাদ করে। আজগুবির একটা সীমা থাকা দরকার। অবশ্য এমনটি শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, সবার ক্ষেত্রেই কমবেশি হচ্ছে।
আন্দোলনে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের অবদান ও অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরে আসিফ নজরুল বলেন, তারা আমাদের কি ভয়াবহ ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে রেহাই দিয়েছে, আজকে ব্যর্থ হলে আমাদের কী অবস্থাটা হতো? এটি যেন আমরা মনে রাখি। আজকে যদি আবারও ব্যর্থ হই, তাহলে সেই অবস্থাই হবে। আমাদের কাছে ভয় লাগে আমরা এবার যদি ব্যর্থ হই, বাংলাদেশ কাশ্মীরে পরিণত হবে, তা না হলেও অবস্থা কাশ্মীরের কাছাকাছিতে পরিণত হবে। আমরা যেন এই বিষয়টি মনে রাখি।
জুলাই–আগস্টের অভ্যুত্থানের বিভিন্ন ঘটনা তুলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থান দেশের সাংবাদিকতার জন্য শ্রেষ্ঠ অর্জন। তিনি বলেন, তখন তিনি বার্তা সংস্থা এএফপির ঢাকা ব্যুরো প্রধান ছিলেন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ওই সময়ে কীভাবে অন্য গণমাধ্যমকে তিনি সহায়তা করেছেন, সেই তথ্যও তুলে ধরেন।
রাখাল রাহা বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলেন যে সকল অভিভাবকরা অংশ নিয়েছিলেন তারা এর আগে কখনই কোনো আন্দোলনে যায়নি। ফেরদৌস আরা রুমী বলেন, যারা বিভেদ তৈরির চেষ্টা করছে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। ফজলুল হক বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতি দেশের জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ছিলো না। সেই জন্যই জনগণ তাদের মনে রাখেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস আছে। তিনি বলেন, এই সরকারের প্রতি এখনও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সতর্ক থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হবে।