ভারতের রাজনীতিবিদদের দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করাসহ চার দফা দাবি জানিয়ে দেশটির চট্টগ্রামে নিযুক্ত সহকারী হাই কমিশন বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গতকাল সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের মাধ্যমে এ স্মারকলিপি দেয়া হয়।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ ময়দানে জড়ো হন হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীরা। সেখানে তারা ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের প্রোপাগান্ডার প্রতিবাদে’ সমাবেশ করা হয়। সমাবেশ শেষে জমিয়তুল ফালাহ জামে মসজিদ থেকে শুরু হয়ে কাজীর দেউড়ি মোড় পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন তারা।
অবশ্য গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে সোমবার (গতকাল) চট্টগ্রাম ভারতীয় সহকারী হাই কমিশন অভিমুখে লং মার্চ করার ঘোষণা দেয় হেফাজত ইসলাম। তবে শেষ মুহূর্তে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করে স্মারকলিপি দেয়া হয়। গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের জানানো হয়, বাংলাদেশ সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুরোধে ভারতীয় দূতাবাস কার্যালয় অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি পরিবর্তন করা হয়েছে’।
গতকালের বিক্ষোভ সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর আইয়ুব বাবুনগরীর সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা নাসির উদ্দিন মনির, যুগ্ম মহাসচিব মুফতি হারুন ইজহার, মাওলানা মীর ইদ্রিস, কেন্দ্রীয় ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা কামরুল ইসলাম কাসেমী, মাওলানা নুরুন্নবী, মাওলানা জুনাইদ বিন ইয়াহিয়া, মাওলানা শহিদুল ইসলাম, মাওলানা কুতুব উদ্দিন, মাওলানা আসহাব উদ্দিন, মাওলানা শিবলী নোমানী ও মাওলানা জিহাদুল ইসলাম। সঞ্চালনা করেন নগর প্রচার সম্পাদক মাওলানা ইকবাল খলিল।
মুফতি হারুন ইজহার বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হাসিনা চলে যাওয়ার পর আমরা দেখলাম অতি বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হঠাৎ করে সরগরম হয়ে উঠল। বিগত ১৭ বছরে হাসিনার ফ্যাসিজম এবং বর্তমান বাংলাদেশের অস্থিরতার পেছনে আওয়ামী লীগ একা দায়ী নয়। তার পেছনে হিন্দুস্তানের আধিপাত্যকে আমি প্রধান দায়ী করতে চাই।
তিনি বলেন, হেফাজতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে পুনর্গঠন হবে না। আজ যারা ক্ষমতায় আছেন, বিগত দিনে আন্দোলন করেছেন তাদের আমি বলতে চাই– কেন শুধু আপনারা ফ্যাসিবাদের কথা বলেন। ফ্যাসিবাদের পেছনে যে ভারতীয় আধিপত্যবাদের হাত রয়েছে তার কথা কেনো আপনারা বলেন না। আমরা ফ্যাসিজমের এ বটবৃক্ষের ডালপালা কেটে দিয়েছি। শেকড় এখনও রয়ে গেছে। আজ আমরা শুধু চিন্ময়ের বিষয় নিয়ে এখানে আসিনি। হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদসহ অসংখ্য সংগঠনকে ভারত পেট্রোনাইজ করে। অনেকে ভারতের টাকা খেয়ে ও তাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশকে অস্থির করার ষড়যন্ত্র করছে। যা কিছু হচ্ছে বাংলাদেশে সুপরিকল্পিতভাবে হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ভারত ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলংকা ভারতীয় আধিপত্যের জাল ছিন্ন করেছে। বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করবো আপনারা বিকল্প বন্ধুরাষ্ট্র খুঁজুন। আমরা পাকিস্তানের কথা বলছি না। আমরা পাকিস্তানি অ্যাম্বেসির টাকা নেই না। পাকিস্তানের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং দক্ষিণ এশিয়ায় চীন রয়েছে। আরও অন্যদেশ রয়েছে। সেসব দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করুন। মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক করুন। তুরষ্ক আছে মালয়েশিয়া আছে। আগ্রাসী ভারতের তুলনায় পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক করতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
হারুন ইজহার বলেন, গত ১৭ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট হাসিনার জগদ্দল পাথর আমাদের ওপর চেপে বসেছিল। রাষ্ট্রীয় প্রতিটি বিভাগকে ধ্বংস করেছিল। ফ্যাসিবাদী শক্তি এখনো ভারতে বসে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের পেছনে ভারতীয় আধিপত্যবাদের হাত রয়েছে। তারা বাংলাদেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। তারা ইসকনকে দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। কিন্তু সাধারণ হিন্দুরা তাদের ফাঁদে পা দেয়নি। আমরা ভারতীয় হাই কমিশনকে বলতে চাই, বাংলাদেশবিরোধী সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ করুন। আপনারা আপানাদের রাজনীতিবিদদের মুখে লাগাম লাগান
তিনি বলেন, আজ এ সমাবেশ থেকে আমি চট্টগ্রামে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনকে বলে দিতে চাই আপনি আপনার সরকারকে বলে দিন, বাংলাদেশ বিরোধী সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। আপনার দেশের সকল রাজনীতিবিদদের মুখে লাগাম লাগান। ভারত যদি শান্তি চায়, তাহলে আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে।
মাওলানা মীর ইদরীস বলেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আর পিছনে ফিরে যাওয়া যায় না। আমরা নড়াচড়া করলে ভারত ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির বলেন, ‘আইনজীবী আলিফ হত্যা মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আসামি করতে হবে। যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে।
স্মারকলিপিতে চার দফা : স্বারকলিপিতে চার দফার মধ্যে রয়েছে– ভারতীয় মিডিয়ার মিথ্যা প্রচার বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ, রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা, দুই দেশের সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সকল ধরনের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা ।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ভারতীয় গণমাধ্যমে যেভাবে বাংলাদেশবিরোধী মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য প্রচার করা হচ্ছে, তা বন্ধে ভারত সরকার যেন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সংক্রান্ত বক্তব্যে অধিক সংযম ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিভ্রান্তমূলক ও অসত্য মন্তব্য যেন অবিলম্বে বন্ধ হয়।
স্মারকালপিতে উল্লেখ করা হয়, বিগত ফ্যাস্টিস্ট সরকারের অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণ ও আদর্শিক ভিন্ন মতালম্বীদের দমন নিপীড়নে ভারতীয় সরকারের সমর্থন এবং তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের নানান অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে। এ জাতীয় তৎপরতার পরিসমাপ্তি কামনা করছে হেফাজত ইসলাম। এছাড়া অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র যদি অব্যাহত থাকে এতে দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদী সুসম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে বলা হয়, এ বিষয়ে আপনার ( সহকারী হাই কমিশন) সরকারের সদয় হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করি, যাতে পরবর্তীতে দুই দেশের মসৃণ ও ইতিবাচক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় থাকে।