লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের শংকা দেখা দিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত শত শত লাইটারেজ জাহাজ ভাড়ার অভাবে অলস বসে থাকে। কয়েক হাজার কোটি টাকার এই সেক্টরে ইতোমধ্যে বিপুল অর্থ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন ভাড়ার জন্য গড়ে ৫শ’টির মতো লাইটারেজ জাহাজ চট্টগ্রামে অবস্থান করলেও ২০/২২টির বেশি ভাড়া পায় না। বাকি জাহাজগুলো অলসভাবে নদী এবং সাগরে ভাসছে। বিদ্যমান সংকট লাগাতার হলে এই সেক্টর অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের আমদানি বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই হ্যান্ডলিং করা হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। এই ৯০ শতাংশ পণ্যের ৫২ শতাংশ হ্যান্ডলিং হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। বাকি ৪৮ শতাংশ হ্যান্ডলিং হয় বহির্নোঙরে। বন্দরের প্রায় সমান পণ্য বহির্নোঙরে খালাস হয়ে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে হ্যান্ডলিং করা হয়। আর এই পণ্যের পুরোটাই হ্যান্ডলিং হয় লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে।
সূত্র জানিয়েছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গম, ভুট্টা, ডাল, চিনি, লবণসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, সার, সিমেন্ট ক্লিংকার, কয়লা, স্টোনসহ রকমারি পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। এসব জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করে। বহির্নোঙরে অবস্থানকারী মাদারভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাটসহ দেশের নানা অঞ্চলে সরবরাহ দেয়া হয়। বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম বন্দরে বার্থিং নেয়া জাহাজের ওভার সাইড থেকেও লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করে দেশের নানা অঞ্চলে সরবরাহ দেয়া হয়। সবকিছু মিলে দেশের পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থা এই সেক্টরের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু আমদানি কমে যাওয়ায় লাইটারেজ জাহাজগুলো ভাড়ার সংকটে পড়েছে। প্রতিমাসে এক ট্রিপ ভাড়া পাচ্ছে না এমন জাহাজের সংখ্যা অনেক। বসিয়ে বসিয়ে নাবিকদের বেতন ভাতা যোগানোর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদ যোগাতে গিয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েন বহু জাহাজ মালিক। গতকালও কর্ণফুলী নদীতে ৫শ’টিরও বেশি লাইটারেজ জাহাজ অলস ভাসছিল বলে সূত্র জানিয়েছে।
লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) একজন কর্মকর্তা জানান, পরিস্থিতি আসলেই খারাপ। এই সেক্টর চরম দুঃসময় পার করছে। অলস জাহাজের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। জাহাজ মালিকেরা নাবিকদের বেতনভাতা যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই বলে মন্তব্য করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ডলার সংকট যে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তাতে সহসা আমদানি বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমদানি না বাড়লে লাইটারেজ জাহাজ ভাড়া পাবে না।
অপর একটি সূত্র জানায়, কোটি কোটি টাকা দাম এক একটি জাহাজের। এসব জাহাজের অধিকাংশই ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। ভাড়া না পাওয়ায় জাহাজ মালিকেরা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে খেলাপি ঋণের পরিমান বাড়ছে।
সংকট প্রকট হয়ে উঠলে জাহাজ কেটে স্ক্র্যাপ করে ফেলার প্রবণতা দেখা দেবে বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ এই খাতটি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
বিষয়টি নিয়ে লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের নেতা শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পরিস্থিতি ভালো নয়। ভাড়া নেই। জাহাজ অলস বসে থাকে। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ এবং ডলার সংকটসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতি এই সেক্টরটিকে একেবারে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে বলেও শেখ জাহাঙ্গীর মন্তব্য করেন।