ভাটির সাধক:বাউল আব্দুল করিমের জীবন ও গান

মো.রবিন ইসলাম | সোমবার , ২৩ জুন, ২০২৫ at ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ

ভাটি অঞ্চল, সুনামগঞ্জ। বছরের একটা বড় সময় এই ভূখণ্ড জলের নিচে ডুবে থাকে। মানুষগুলো দিনের পর দিন আটকা পড়ে প্রকৃতির করুণায়। সময় কাটে ধ্যান, গান আর প্রতীক্ষায়। এই জলের দেশ, মাটির গন্ধ আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে এক বিস্ময়কর সাংগীতিক ধারাযার মূল সুরধারক একজনই: বাউল শাহ আব্দুল করিম।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে ১৯১৬ সালে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেন শাহ আব্দুল করিম। তার পিতা ইব্রাহিম আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে ছিলেন তিনি। ছোটবেলায়ই জীবনের কষাঘাতে জর্জরিত হন করিম। কালনী নদীর তীরঘেঁষা তার শৈশবের গ্রাম, যেখানে রোদ ছিল, কিন্তু সে রোদের নিচে তেমন উষ্ণতা ছিল নাছিল কেবল বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

রাখালের জীবন, গানের বীজ

ছোটবেলায় দাদা নসিবউল্লাহর মুখে শুনতেন আধ্যাত্মিক সব গান। সেসব গান হৃদয়ের গহীনে বুনে দিত ভাবনার বীজ। মাত্র ১১১২ বছর বয়সে তাকে রাখালের কাজ নিতে হয় গ্রামের মোড়লের বাড়িতেবেতন মাত্র দুই টাকা। গরু চরাতে গিয়ে তিনি আপন মনে গেয়ে উঠতেন:

ভাবিয়া দেখ মনে,

মাটির সারিন্দা রে বাজায় কোন জনে…”

বর্ষায় রাখালির কাজ থাকতো না, তখন মুদি দোকানে কিংবা কৃষিজমিতে কাজ করতেন তিনি। কিন্তু যত কাজই করুন, গানই ছিল তার নিঃশ্বাসের অক্সিজেন।

আট দিনের স্কুল, আজীবনের পাঠ

ব্রিটিশ আমলে একবার একটি নাইট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন শাহ আব্দুল করিম। কিন্তু মানুষজন ভুল ধারণা করলোনাইট স্কুলে পড়লে বুঝি জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হবে! মাত্র আটদিন ক্লাস করেই সেই স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। যদিও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তার হয়নি বললেই চলে, তবু তিনি নিজে নিজে শিখেছেন, শিখেছেন জীবন, মাটি আর মানুষের কাছ থেকে।

গ্রামত্যাগ: সত্য বলার অপরাধ

গানের প্রতি ভালোবাসা তার জীবন থেকে কেড়ে নেয় নিজ গ্রাম। এক ঈদের জামাতে তাকে তওবা করতে বলা হয়আর গান না করার অঙ্গীকার করতে বলা হয়। কিন্তু করিম বলেন,

পরে করিব যাহা, এখন যদি বলি করব না,

সভাতে এই মিথ্যা কথা বলতে পারব না।”

এই সত্যভাষণের অপরাধেই তাকে কাফের আখ্যা দিয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

গন্ধা গ্রামে স্বর্ণালী সময়

গ্রাম ছাড়া যুবক করিম ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে গন্ধা গ্রামে আসেন। এখানকার গানবাজনার ঐতিহ্য তাকে আপন করে নেয়। থাকতেন ‘আলতার মা’ নামে এক বিধবার বাড়িতে। গন্ধায় তার গায়কী মুগ্ধ করে সবাইকে। এখান থেকেই গানের জগতে তার অবস্থান গড়ে ওঠে। যদিও রহস্যজনকভাবে পরবর্তীতে এই গ্রামের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়।

ভবের মূর্চ্ছনায় ছুঁয়ে যাওয়া দিন

আব্দুল করিম এখন দিনরাত গান করেন। দূরদুরান্ত থেকে তাঁর গানের বায়না আসে, অনুরাগীরা ছুটে আসে ভাটির প্রান্ত থেকে। সহজ কথার গভীরতায় মোড়া তাঁর গান শুনে মানুষ ভাবাবেগে ভেসে যায়। সেই গানে আকৃষ্ট হয়ে আপ্লুত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও।

একবার সুনামগঞ্জ সফরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় করিমের। করিম গান শোনালেন, বঙ্গবন্ধু মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। শিল্পের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দুর্বলতা চিরন্তন; তিনি আবেগে বিহ্বল হয়ে করিমকে বলেছিলেন, “আপনার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হবে। এই মুজিব বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বাঁচবেন, ইনশাআল্লাহ।”

এই মুগ্ধতা বঙ্গবন্ধু ভাগ করে নিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানীর সঙ্গেও। কাগমারির এক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী করিমের গান শুনে আশীর্বাদ করেছিলেন: “আব্দুল করিম একদিন অনেক বড় শিল্পী হবেন।” কিন্তু সত্যিই কি তিনি তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছিলেন? হয়তো না। বঙ্গবন্ধুর অসময়ে বিদায় না হলে হয়তো তাঁর কদর আরও বিস্তৃত হতো।

যা কিছু প্রাপ্তি, তা মানুষের ভালোবাসা। করিম যেখানেই গান শুনিয়েছেন, সেখানেই তাঁর সহজ কথার মধ্যে লুকিয়ে থাকা গভীরতা শ্রোতাকে মোহিত করেছে। একসময় তাঁকে ঘিরে বিতর্কও উঠেছিলতিনি কি বাউল? তিনি কি নাস্তিক? কিন্তু করিম গানকে দেখেছেন মনের ভাব প্রকাশের এক ভাষা হিসেবে। তাঁর গানে যেমন ছিল আধ্যাত্মিকতা, তেমনি ছিল ভাটির নিপীড়িত মানুষের কষ্টের প্রতিচ্ছবি। তিনি বিশ্বাস করতেন, স্রষ্টা আছেন, মানুষের মাঝেই আছেন। মানবদেহের রহস্য তাঁকে দিনের পর দিন ভাবিয়ে তুলত।

সরলতা যার প্রকৃতি

আব্দুল করিম ছিলেন অতিশয় সরল প্রকৃতির মানুষ। তাঁকে ঘিরে যত আলোচনা, উৎসাহ কিংবা বিতর্কই হোক না কেনতিনি ছিলেন এসবের ঊর্ধ্বে, নিজের জগতে নিমগ্ন। সেই জগতে চাওয়াপাওয়ার পরিধি ছিল খুবই ক্ষুদ্র।

একবার সুনামগঞ্জে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ঘোষণা এল-“বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের হাতে তুলে দেওয়া হবে তিন লাখ টাকার সম্মাননা চেক।” তখন করিম বার্ধক্যে উপনীত, কানে একটু কম শোনেন। পাশে বসা একমাত্র সন্তান জালালকে জিজ্ঞেস করলেন, “জালাল, ইতা কিতা কয়? তিন হাজার টাকা? এত ট্যাকা দিয়া আমি কি করতাম!”

তাঁকে আস্তে করে জানানো হলোতিন হাজার নয়, তিন লাখ টাকা!

তাঁর মুখে বিস্ময়, কণ্ঠে আতঙ্ক-“তিন লাখ? সর্বনাশ! অত ট্যাকা! এগুলা নিয়্যা আমরা কিতা করমু? আমরার ট্যাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড় প্রাপ্তি।”

বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “চল চল, বাড়ি চল।” এবং সত্যিই বাড়ির পথ ধরলেন।

এই মানুষটিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আজ যখন মানুষ প্রাপ্তির পেছনে ছোটে, তখন এই মানুষটি জীবনের পরম প্রাপ্তি খুঁজে পান ভালোবাসার মাঝে। অর্থ তাঁর কাছে গুরুত্বহীন। শিল্পীসত্তা তাঁর ছিল আত্মিক, মাটির, মানুষের।

আসলে, আব্দুল করিম ছিলেন এক অনন্য কবিগায়ক, যিনি গানের সুরে মানুষের আত্মা ছুঁয়ে গিয়েছিলেন।

প্রথম প্রেম, প্রথম বিয়ে

শাহ আব্দুল করিমভাটির বাউল, লোকগানের দরদী সাধক। জীবনের প্রতিটি পরতে ছিল গান আর মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। প্রথম প্রেম ছিল তার সুরের সাথে, আর সেই প্রেমে ডুবেই শুরু হয়েছিল এক ভিন্নধর্মী জীবনের অধ্যায়।

তখন সদ্য বিয়ে করেছেন কাচামালা নামের এক নারীকে। অথচ, তার সমস্ত মনোযোগ তখন গানের মাঝে। লিখছেন, গাইছেন, বেঁধে চলেছেন একের পর এক সুরেলা জগত। রাতভর গান, আসর আর মানুষের মজমায় ডুবে থাকতেন তিনি। ঘরে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী আছেনএ কথা প্রায় ভুলেই যেতেন।

এতেই প্রথম সংসারে দেখা দেয় টানাপোড়েন। এক সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে ডেকে পাঠানো হয় তাকে। শর্ত দেয়া হয়হয় স্ত্রী, নয় গান। আব্দুল করিম গান বেছে নেন। সংসার ভাঙে, কিন্তু গান ছাড়েননি তিনি। তিনি জানতেন, গানই তার জীবনের পথ, জীবনের সত্য। জোর করে সংসার করে মেয়েটির প্রতি অন্যায় করতে চাননি।

তার গানের মতোই তার জীবনও সরল কিন্তু গভীর

গান গাই আমার মনরে বুঝাই, মন থাকে পাগলপারা

আর কিছু চাই না মনে গান ছাড়া…”

সরলার প্রেমে মগ্নতা

গানের এই সাধকের জীবনে আবার আসে প্রেমনির্লোভ, নিরাভিমান এক প্রেম। আফতাবুন্নেসা, যাকে আব্দুল করিম আদর করে ডাকতেন ‘সরলা’।

এই সরলাই হয়ে ওঠেন তার জীবনসঙ্গিনী,তার মুর্শিদ। সংসারের সব কষ্ট, দারিদ্র্য, অনাহার হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন তিনি। করিম যখন গ্রামের পর গ্রামে ঘুরে গান গাইতেন, তখন সরলা নীরবে সামলে রাখতেন সংসার। প্রয়োজন পড়লে মানুষে বাড়িতে কাজ করতেন, কিন্তু কোনোদিন করিমকে বুঝতে দিতেন না দুঃখের ছায়া।

তিনি বিশ্বাস করতেন, সংসারের চিন্তা যেন করিমের গানের উপর প্রভাব না ফেলে। বলতেন

আমি যদি আপনাকে আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে বেঁধে রাখি, আপনি বাইরে যাবেন কেমনে? আর আপনি যদি বাইরের মানুষের সঙ্গে না মেশেন, তবে জগৎ চিনবেন কেমনে আর গান বানাইবেন কেমনে?”

এই প্রেম হয়তো ইতিহাসে অমর হবে না, কিন্তু এই প্রেম বড্ড সত্য, বড্ড অদ্ভুত।

অবহেলা ও আক্ষেপ

শাহ আব্দুল করিম তার জীবনে সম্মান পেলেন কম। পোশাক, পদবি, কিংবা আর্থিক অবস্থার কারণে দেশে মানুষের চোখে ছোট হয়ে থেকেছেন অনেক সময়। একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আক্ষেপ নিয়ে

আমার পাঞ্জাবি ছেঁড়া তো কী হয়েছে, আমি কি এই দেশের নাগরিক না? আমার লুঙ্গিতে তিনটা তালি আছে, কিন্তু আমি তো কোনোদিন ট্যাক্স ফাঁকি দেইনি!”

তার গান বারবার ব্যবহার হয়েছে, রিমিক্স হয়েছে, কিন্তু তার নাম ও সম্মান হারিয়ে গেছে চটকদার সুরের ভিড়ে।

এক বাউলের মহাপ্রস্থান

২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। ভাটির মাটি যেন হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে গেল। শাহ আব্দুল করিম নেই। লাখো ভক্তের চোখে জল, হৃদয়ে বেদনা। শহীদ মিনারে রাখা হয় তার নিথর দেহ। বাউলদের কণ্ঠে বেজে ওঠে

কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি…”

এরপর নৌকার বহর চলে ধলগ্রামের দিকে। একটি বড় নৌকায় ফুলে মোড়া একটি দেহসেই দেহে শুয়ে আছেন আব্দুল করিম। সেই মসজিদেই তার জানাজা, যেখান থেকে একদিন ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু নিয়তি হয়তো সবশেষে ঠিক ঠিক হিসেব চুকায়। মৃত্যুর পর শায়িত হলেন সেই মুর্শিদা, প্রিয়তমা সরলার পাশেই।

জীবনের গান

তিনি একসময় লিখেছিলেন

তুমি সুজন কান্ডারি, নৌকা সাবধানে চালাও

মহাজনে বানাইয়াছে ময়ূরপঙ্খি নাও…”

আজ সেই ময়ূরপঙ্খি নাও চলে গেছে চিরকালের পথে। আমরা শুধু স্মরণ করি তাঁকে, হৃদয়ে গেয়ে যাই

আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা…”

পূর্ববর্তী নিবন্ধসড়ক দুর্ঘটনা: আকস্মিক ঘটনা নাকি খুন?
পরবর্তী নিবন্ধলায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং ফটিকছড়ির চারা বিতরণ