ভাঙাভাঙি

সত্যব্রত বড়ুয়া | সোমবার , ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

আমার এক অতি পরিচিতজন সেদিন আমাকে বললেন, শুনছি আছাড় খেয়ে আপনি কোমড়ের হাঁড় ভেঙে চলাফেরা করতে পারছেন না। আমি হেসে বললাম, শুধু এবারই নয় আমার জীবনে ভাঙচুর বেশ কয়েকবার হয়েছে। এর আগে হাত, পা ভেঙেছে। ভাঙা ভাঙি চলছেই। দেখুন, সংস্কৃতির মানেই হলো ভাঙা ভাঙি হওয়া। এভাবেই সংস্কৃতি বিকশিত হয়। আমি নিজেকে একজন সংস্কৃতিমান মানুষ বলে মনে করি। বলা যেতে পারে এটা আমার অহঙ্কার। আমার মতো মানুষরা সবসময় পরিবর্তনশীল। এক সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ভূট্টোকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি এতো মিথ্যা কথা বলেন কেন। সকালে এক কথা বললে বিকালে আরেক কথা বলেন। উত্তরে ভুট্টো বললেন আমি সৃষ্টিশীল মানুষ, এ জন্য সংস্কৃতিমান। আমারটাকে তাই মিথ্যা কথা বলা যাবে না। জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো আমিও সারাদিন মিথ্যা কথা বলি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এর পরেও সবাই আমাকে একজন সত্যবাদী মানুষ বলে মনে করে। আমার ধারণা এটা আমার ‘গুড উইল’এর জন্য হয়েছে। এক সময় হয়তো সত্যি সত্যিই সত্যবাদী ছিলাম। কিন্তু সংস্কৃতিমান ছিলাম কী! তখন ভাঙচুর হতো না। এখন হয় বলেই মিথ্যা কথা বলি। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছি। আমি একবার আমার এক শুভানুধ্যায়ীকে বলেছিলাম, দেখুন আমরা সবাই বাবুই পাখিকে নিপুন শিল্পী বলে মনে করি। আমি বলবো সে নিপুনভাবে ঘর তৈরি করতে পারলেও সংস্কৃতিমান নয়। কারণ এই পাখিটি ঘর তৈরি করে বংশগতভাবে। তার পূর্ব পুরুষরাও এভাবে করেছে। ভবিষ্যতের বাবুইরাও ঠিক একভাবেই করবে। কোনো পরিবর্তন হবে না। বাবুই পাখি তাই সৃষ্টিশীল নয়। প্রাণিদের মধ্যে একমাত্র মানুষই সৃষ্টিশীল। বাঁদরের বাবা যেভাবে বাদঁরামি করেছে, সে তাই করছে। তার সন্তানেরাও তাই করবে। বুড়ো হলেও মুখ ভেংচি কাটবে। রবি ঠাকুর শান্তিনিকিতনে সব সময় তাঁর ঘরের ‘প্যাটার্ন’ পরিবর্তন করতেন। কবিতা লিখে বার বার কাটাকাটি করতেন। এই কাটাকুটিকে তাঁর ভক্তরা বললো উঁচু মানের আধুনিক আর্ট। হয়ে গেলেন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী। কবিতার ছন্দের পরিবর্তন হচ্ছে। গল্প, প্রবন্ধ, নাচ, গানের ভঙ্গিমাও পাল্টে যাচ্ছে। হচ্ছে ভাঙচুর। অণু ভেঙে হয় পরমাণু। সৃষ্টি হয় মহাশক্তি। ভাঙাভাঙি হবেই। আমার মা আমাদের বাবার চড়থাপ্পর হতে বাঁচাবার জন্য মিথ্যা কথা বলতেন। বলতেন আমরা পড়ছি। লক্ষ্য করতাম তিনি প্রায় সময়ই তাঁর রান্নার ধরণ পাল্টাতেন। তিনি রসিকজন ছিলেন। ছিলেন আড্ডাবাজ। তাঁর মধ্যে আমি ভাঙাভাঙি হতে দেখেছি। তিনি বেশি পড়াশনা না করলেও সংস্কৃতিমান ছিলেন। ‘নদীর একূল ভাঙে ও কূল গড়ে’। ভাঙ্গাগড়া চলছে। চলবেই। এক সময় আমাদের আর ভাঙাভাঙি হয়না। এরপর? ‘ফুস’!

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধতথ্যচিত্রের জনক ইয়োরিস ইভেন্স