কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে ধেয়ে আসা উজানের পানিতে পরশুরাম ফুলগাজী ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার প্রায় শতভাগ এলাকা পানির নীচে তলিয়ে গেছে। কোনো কোনো রাস্তাঘাট ১০–১৫ ফুট ও কোনো কোনো এলাকা ২০ ফুট পানির নীচে ছিলো। শুধু তাই নয় ফেনী শহরের ট্রাংক রোড়সহ পুরো শহর ৫–১০ ফুট ও ব্যস্ততম পাঁচগাছিয়া রোড় ১০ ফুট পানির নীচে তলিয়ে গিয়েছিলো। গত মঙ্গলবার থেকে বিদ্যুৎ নেই, ফলে মোবাইলে চার্জ দিতে না পারায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন উপজেলার লাখ লাখ মানুষ। অনেকে বেঁচে আছে না মরে গেছে সেটাও জানা যাচ্ছে না। যারা ইঞ্জিন নৌকা ও বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে গিয়েছেন, তারা ফুলগাজী পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া পর্যন্ত গিয়ে ত্রাণ দিতে বা উদ্ধার করতে পারছেন না। কারণ ফেনী শহর থেকে পরশুরামের দূরত্ব ৩০–৩৫ কিলোমিটার ও ছাগলনাইয়া ফুলগাজীর দূরত্ব ১৫–২০ কিলোমিটার। যে সব নৌযান ফেনীতে উদ্ধার অভিযানে গিয়েছে সেগুলো এতো দূরে গিয়ে মানুষ উদ্ধার করে আবার ফেরত আসার মত নৌযান নয়। স্প্রিড বোর্ড ছাড়া এসব দুর্গত মানুষকে উদ্ধার করা অসম্ভব। তাই ঐসব এলাকার মানুষের অবস্থা ভয়াবহ। তারা উদ্ধারের আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছিলো, কিন্তু সেটি হয় নাই। অন্যদিকে সর্বত্র পানি হওয়ায় রান্নাবান্না করা যাচ্ছে না। অভুক্ত মানুষগুলো দিন পার করেছে উদ্ধার, খাদ্য ও ত্রাণের আাশায়। বিদ্যুৎ ও খাদ্যের অভাবে এসব মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যারা একটু সচ্ছল নিজ বাড়িতে ২–৩ তলায় অবস্থান করছেন তারা বিদ্যুৎ ও পানির অভাবে আছেন অন্যরকম এক কষ্টে। টাকা দিয়ে বিশুদ্ধ পানি ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনবেন সেই অবস্থাও নেই। সব দোকানপাট বন্ধ ও দোকানে থাকা সমস্ত মালামাল পানির নিচে থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে। এ যেন এক ভয়াবহ দুর্বিষহ অবস্থ। কেউ কাউকে সাহায্য করার মত অবস্থায় নেই। তবে স্কুল কলেজের ছাত্র ও যুবক শ্রেণির স্থানীয় মানুষ এই দুর্গত মানুষকে উদ্ধারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছেন। মোটামুটি একটু উঁচু স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা ও মন্দিরের ভবনগুলো আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে অধিকাংশ গবাদি পশু, হাস মুরগী ও পশুপাখি মারা পড়েছে। তাই বলতে হয় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে ফেনী।
বৃহস্পতিবার বিকালে আমি ফেনীর অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য রওয়ানা হই। বারৈয়ারহাটের আগে বিএসআরএম কারখানার বিপরীত সাইডে পানি থাকায় বিপরীতমুখী গাড়িও একই লাইনে চলতে দেখি। ধীরগতি হলেও গাড়ি চলাচল করায় সেটি পার হয়ে মুহুরি ব্রীজ পার হতেই দেখি গাড়ির জ্যাম। কোন গাড়ি চলছে না, ঠায় দাড়িয়ে আছে। অগত্যা মুহুরীগঞ্জের পিএইচপি কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে আশেপাশের এলাকা ভালভাবে হেঁটে দেখলাম। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। দুয়েকটা ঘরের চালের টিন এবং গাছের ঢাল ও পাতা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। শতশত মানুষ রাস্তার উপর এসে আশ্রয়ের খোঁজে দিগবিদিক ছুটছে। রাস্তার উপর ৩–৪ ফুট পানি। দেখলাম স্বেচ্ছাসেবীরা রাস্তা বন্ধ করে শুধু ত্রাণের গাড়ি ও নৌকা বহন করা গাড়ি যেতে দিচ্ছে। আমি ওদেরকে অনেক রিকোয়েস্ট করে আরো সামনের দিকে রওয়ানা হলাম। আস্তে আস্তে প্রায় ৭–৮ কিলোমিটার যাওয়ার পর ফাজিলপুর গিয়ে দেখলাম আর যাওয়ার উপায় নেই। সামনে পিছনে ডানে বামে শুধু পানি আর পানি। রাস্তার এক সাইডে পানি ৩–৪ ফুট হলেও বিপরীত সাইডের রাস্তায় প্রায় ৪–৫ ফুট পানি। রাস্তার ডিভাইডার উপচে পানি এপাশে পড়ছে। ডিভাইডারের ছোট ছোট ফাক দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। মনে হলো কেউ পাম্প দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে পানি ছাড়ছে। যেখানে ইউটার্ন আছে সেখানে দেখলাম পানির স্রোত সাগরের প্রচণ্ড ঢেউয়ের মত। স্রোতের জন্য ওখানে দাঁড়ানো বা হাঁটা যাচ্ছে না। সেজন্য স্বেচ্ছাসেবীরা ইউটার্নের জায়গায় মোটা দড়ি বেঁধে দিয়েছে এবং মানুষ সেই দড়ি ধরে হাঁটছে। এটি না করলে ঐ জায়গায় অনেক মানুষ ভেসে যেতো। রাস্তার এপারে যে পানি পড়ছে সেই পানি সোনাগাজী হয়ে সাগরে পতিত হয় এবং সেভাবেই নিষ্কাশিত হবে। কিন্তু অত্যধিক পানি ঢাকা চিটাগং রোড পার হয়ে সোনাগাজী অঞ্চলে পড়ায় শুক্রবার থেকে সোনাগাজী উপজেলা পানিতে তলিয়ে গেছে। কারণ সোনাগাজী উপজেলায় উপকূলে যে উঁচু বেড়িবাঁধ আছে সেটি অতিক্রম করতে পারছে না পানি। পানিকে মুহুরী ড্যামের কপাট দিয়ে নিষ্কশিত হয়ে সাগরে যেতে হবে। তাই সোনাগাজী উপজেলা এখন ৮–১০ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে পানির চাপ খুব বেশি হলে বেড়িবাঁধ ভেঙেও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির সাথে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানি ও ভারতের কলসী ড্যামের কপাট খোলার পানির জন্য আজ ফেনীর এই ভয়াবহ অবস্থা। এ বছর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় ওখানে প্রচণ্ড বন্যা হয়েছে এবং অনেক মানুষ মারাও গেছে। তবে দক্ষিণ ত্রিপুরা রাজ্যের পানির ধারণ ক্ষমতা থেকে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় ভারত সরকার কলসি বাঁধ খুলে দেয় বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন। যদিও ভারত এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি, তবে ভারতের ‘তবব ২৪ ঘন্টা‘ নিউজ চ্যানেলে ২১/০৮/২০২৪ তারিখে ৫.১৮ তে বলেছে “ভারত ছাড়লো জল! হাবুডুবু খেতে খেতে বাংলাদেশের কাতর আর্জি—“। সেই হঠাৎ ছেড়ে দেওয়া পানির সাথে বৃষ্টির পানি মিশে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে এসে মুহূর্তের মধ্যে ভাসিয়ে দেয় ফেনীর বর্ডার এলাকা পরশুরাম ফুলগাজী ছাগলনাইয়া ও ফেনী। তবে এবারের অতিবৃষ্টির বন্যা যে ড্যাম–ব্যারাজ খোলার জন্যই বিপর্যয়কর হয়েছে স্রোত দেখে সেটি বোঝা যায়। কারণ স্বাভাবিক বন্যার পানি নদীতে গ্রোত তৈরি করতে পারে কিন্তু মাঠ ও বসতিতে গ্রোত তৈরি করে না।
অন্যদিকে স্বাভাবিক বন্যায় পানি কয়েকদিন ধরে ধীরে ধীরে বাড়ে ও ধীরে ধীরে চলে যায়। কিন্তু হঠাৎ ড্যাম বা ব্যারাজ খুলে দিলে ৩–৪ দিনের আসা পানি তিন ঘণ্টার ঘনত্বে চলে আসে। আর যদি ভাটির দেশকে না জানিয়ে ব্যারাজ ছাড়া হয়, তাহলে বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি ও দুর্গতদের উদ্ধার তৎপরতার সময়ও থাকে না। জানমালের ক্ষতি অনেক বেশি হয়। এবার ফেনীর ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। তবে গত কয়েকদিন বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকায় পরশুরাম ফুলগাজী ছাগলনাইয়া ও ফেনী শহরের পানি অনেক কমেছে যদিও ধীরগতিতে। পানি পুরোপুরি নামতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা শুরু হয়েছে। পানি কমার সাথে সাথে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খাদ্য সাহায্যের জন্য আবেদন করছেন। অন্যদিকে ফেনীর উত্তর অঞ্চলের পানি নেমে দক্ষিণ অঞ্চল সোনাগাজীতে জমা হওয়ায় সেখানের বেশিরভাগ বাড়িঘর গাছ পালা ডুবে গেছে। এখন সেখানেও চলছে উদ্ধার অভিযান। তবে এবার বন্যায় কতটা বিপর্যয়কর হয়েছে সেটি পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর আরো বেশি বোঝা যাবে।
তবে এতো কিছুর পরও আশার কথা হচ্ছে ফেনীর ছাত্র যুবক ও আপামর জনসাধারণ নিজ উদ্যোগে উদ্ধার ও ত্রাণকার্যে নেমে এসেছে। বাইরে থেকে উদ্ধার অভিযান চলবে সেই আশায় বসে না থেকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একসাথে উদ্ধার করেছে একে অপরকে। ফলে এখনো মৃতের সংখ্যা বেশ কম। বহু হিন্দু সমপ্রদায়ের লোক আশ্রয় নিয়েছে মসজিদের আঙিনায় এবং মুসলমান আশ্রয় নিয়েছে হিন্দু উপসনালয়ের আঙিনায়। এ যেন সমপ্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যেটি শিক্ষণীয় ও দৃষ্টান্তমূলক। সারাদেশের জনগণ নিজ উদ্যোগে টাকা সংগ্রহ করছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে দুর্গতদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করছে। এতে এতো বেশি সাড়া পাওয়া গেছে যা আগে কখনো দেখা যায় নাই। বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসা ও মন্দিরের দানের টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে ত্রাণ কার্যে। অনেক হিন্দু সমপ্রদায় তাদের পূজার ব্যয় সংকোচন করে ত্রাণ কার্যে অংশ নিচ্ছে। ছাত্ররা বৃষ্টিতে ভিজে ঢাকা চিটাগং রোডে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে রাতদিন অবিরাম। যতটুকু পারছে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে পৌঁছাচ্ছে দুর্গত মানুষের কাছে। শত শত নৌকা নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে দুর্গত এলাকায়। কোন পারিশ্রমিক ছাড়া হাইওয়েতে স্রোতের টানে বিপন্ন গাড়িকে টেনে উদ্ধার করছে। গলা পরিমাণ পানিতে পড়ে যাওয়া মোটর সাইকেলকে পানিতে নেমে টেনে তুলছে ডাঙায়। এই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, যেন এক অন্য বাংলাদেশ, যা আগে কখনো দেখিনি। তাই বলতে ইচ্ছে করছে যত প্রতিকূল অবস্থা হোক না কেন, এই জাতিকে কেউ কখনো দমাইয়া রাখতে পারবে না। তারা সর্বক্ষেত্রে জয়ী হবে এবং সেটি নিশ্চিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট