এক কাপ কফি না হলে দিনই চলে না অনেকের। ট্যাপ খুলে সামান্য পানি কেতলিতে ভরেই বানানো যায় কফি। কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছেন, উৎপাদন পর্যায়ের শুরু থেকে এক কাপ কফির পেছনে কি পরিমাণ পানি খরচ হয়! জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, কফি গাছের বেড়ে ওঠা, কফি প্রক্রিয়াকরণ শেষে কাপ পর্যন্ত আসতে প্রতি কাপ কফির পেছনে খরচ হয় ১৪০ লিটার পানি! কেবল কফিই নয়, প্রতিদিন ব্যবহারের প্রতিটি পণ্যের পেছনেই ব্যয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ পানি, যার মূল্য ওই পণ্যমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি।
এফএও’র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী যত পানি ব্যবহার হয়, তার ৭০ শতাংশ খরচ হয় কৃষি সেঁচে। কৃষির উপখাত বিবেচনা করলে সবচেয়ে বেশি পানি খরচ হয় মাংস, পোল্ট্রি ও বাদাম উৎপাদনে। এক কেজি গরুর মাংস উৎপাদনে গড়ে ১৫ হাজার ৪১৫ লিটার পানি খরচ হয়। এর বড় অংশই ব্যবহার হয় পশুখাদ্য উৎপাদনে। তুলনামূলক কম পানি লাগে ফল উৎপাদনে। একটি আপেল পেতে ব্যয় হয় ৭০ লিটার পানি। তবে আপেলটিকে এক গ্লাস জুসে পরিণত করতে দরকার হয় ১৯০ লিটার পানি! কৃষিতেই যে সবচেয়ে বেশি হারে পানি ব্যবহার হয়, তা নয়। প্রতি বছর ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের ব্যবহৃত পোশাক উৎপাদনে যে পরিমাণ পানির দরকার হয়, তা অলিম্পিক আকারের ৩ কোটি ২০ লাখ সুইমিং পুলের পানির সমান। একটি টি–শার্ট বানাতে খরচ করতে হয় ২ হাজার ৭২০ লিটার পানি। একটি জিন্স প্যান্ট বানাতে খরচ হয় ১০ হাজার লিটার পানি। গ্রিনপিসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে থাকা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বছরে যে পরিমাণ পানি ব্যয় করে, তা ১০০ কোটি মানুষের পানির চাহিদার সমান। বিভিন্ন দেশ যে পরিমাণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, তা চালু হলে ২০০ কোটি মানুষের চাহিদার সমান পানি খাবে কেন্দ্রগুলো।
বিশ্বে পানি যেহেতু অসীম নয়, তাই কৃষি, শিল্প ও ভোক্তার পানির চাহিদা মেটানোও টেকসই নয়। আবার বিশ্বে জনসংখ্যাও বাড়ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে মানুষের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৯৮০ কোটি। তখন বিদ্যমান পানি ও অন্যান্য সম্পদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে।
পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। ধরণী তো তাহলে পানিতে ভরা হওয়ার কথা। তবে যেখানে ভরপুরা সেখানেই আবার শূণ্যতার উপস্থিতি! বড় অবাক করা বৈপরিত্য। তিনভাগ জলে টুইটম্বুর থাকা পৃথিবী আজ ভয়াবহ পানি সংকটের মুখোমুখি।
গোল্ডম্যান স্যাক্স নামে একটি আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিল, পানিই হবে আগামী শতাব্দীর পেট্রোলিয়াম। তেল সম্পদের লোভে যুদ্ধের কথা শুনে বড় হওয়া প্রজন্ম আমরা। সেখানে নতুন এই পেট্রোলিয়ামের কথাও শুনতে হলো। আরো অবাক করা এই যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই নাকি গড়াতে পারে এই পানি–কে নিয়ে!
প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস কয়েক বছর আগেই সতর্ক করে বলেছিলেন, “পানির স্বল্পতা বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। জীবিত মানুষের পানি পাওয়ার অধিকার থাকা জরুরী এবং এটা হবে ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।” ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. ইসমাইল সেরাগেলডিন বলেছিলেন, ‘যদি এ শতাব্দীতে তেল নিয়ে যুদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে আগামী শতকে সেই যুদ্ধ হবে পানি নিয়ে, যদি না আমরা এই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ব্যবস্থাপনায় আপনাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন আনতে না পারি।’
আমরা আরো কিছু তথ্য–উপাত্ত খতিয়ে দেখতে পারি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাও বলেছে, ভূগর্ভস্থ পানির উৎস দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। পাশাপাশি সংস্থাটি পানির স্বল্পতাকে সারা বিশ্বের জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, বিশ্বের ৬৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ পানীয় জলের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সামনের দিনগুলোতে বিশ্বের প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ পানি সংকটে পড়বে, যার অর্ধেকই দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার। ওয়ার্ল্ড ভিশনের ২০২২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীর ১০টি দেশ তীব্রভাবে বিশুদ্ধ সুপেয় পানি বঞ্চিত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই তালিকার শীর্ষে থাকা ১০টি দেশে বিশ্বের দুই–তৃতীয়াংশ মানুষের বাস।
গবেষকরা বলেছেন, ২০১৮ সালে বিশ্বের প্রায় ৩৫০ কোটি মানুষ অন্তত এক মাস পানি সংকটে ভুগেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০০ কোটিতে। গবেষকেরা বলছেন, ২০৪০ সাল নাগাদ প্রতি চারটির শিশুর মধ্যে একটি মারাত্মক পানি সংকটে থাকা এলাকায় বসবাস করবে। এখনই বিশ্বে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পানি পায় না অথবা তাদের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছায় না। এক গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে ১১০ কোটি মানুষ প্রতিদিন পান করার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি পায় না এবং প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার শিশু দূষিত পানি পান করে মারা যাচ্ছে।
২০২১ সালে বিবিসি ফিউচারের এক লেখায় দাবি করা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে বাঁধ নির্মাণের সংখ্যা নজিরবিহীন বাড়ছে। এতে ভাটিতে থাকা লোকজন পানির সংকটে পড়ে যাবে। বেড়ে যাবে সংঘাত। বর্তমান সময়ে এসে জলবায়ু পরিবর্তন এই সংঘাতকে আরও অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। অনেক বেশি পানি বাষ্পায়িত হয়ে পানিচক্রকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। আরো দু:খের বিষয় এই যে, পানির তীব্র সংকটে যারা রয়েছে এর অধিকাংশই দরিদ্র শ্রেণির মানুষ।
এমন একসময় আসতে পারে যখন পানির দখলের জন্য প্রচেষ্টা শুরু হবে। জাতিসংঘ বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ পানি সংকটের এলাকাগুলোতে বিশ্বের দুই–তৃতীয়াংশ মানুষ বসবাস করবে। এর বছর পাঁচেক পর পানির অভাবের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে ৭০ কোটি মানুষ। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইয়েমেন থেকে ভারত, মধ্য আমেরিকা থেকে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল–বিশ্বের এক–চতুর্থাংশ মানুষ চরম পানি সংকটের মধ্যে আছে। এতে সংঘাত, সামাজিক অস্থিরতা ও বাস্তুচ্যুতির ঘটনা প্রবল আকার ধারণ করবে।
এরইমধ্যে কিছু বিপজ্জনক চিত্র দৃশ্যমান হচ্ছে। ইরানের উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। সমপ্রতি তেহরান প্রদেশের পানি ব্যবস্থাপনা সংস্থা জানিয়েছে, রাজধানীর পানির যোগানদাতা বাঁধগুলোর মজুদ গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে। এ সংকটের পেছনে টানা পাঁচ বছরের খরা এবং চলতি বছরে কম বৃষ্টিপাত দায়ী, যা গত ৬০ বছরে নজিরবিহীন। বাঁধের পানি কমে যাওয়ায় সরাসরি পানির সরবরাহ ব্যবস্থায় চাপ বেড়েছে এবং বহু এলাকায় পানির চাপ দৃশ্যমানভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বসম্পদ ইনস্টিটিউটের (ডব্লিউআরআই) মতো আন্তর্জাতিক সূত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান এখন উচ্চমাত্রার পানি সংকটে চাপের মধ্যে রয়েছে, কারণ দেশটি প্রতিবছর তার নবায়নযোগ্য পানিসম্পদের ৮৩ শতাংশেরও বেশি ব্যবহার করছে, যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে এই চাপের সীমা ৪০ শতাংশের নিচে থাকাকে নিরাপদ ধরা হয়। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটি বহু আগেই সতর্কতার সীমা অতিক্রম করেছে। সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, ব্যবস্থাপনাগত কিছু ত্রুটির পাশাপাশি ধারাবাহিক খরা ও ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে দেশটি এক সর্বব্যাপী সংকটের মুখোমুখি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের পানি সংকট একটি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ, যার সমাধান একদিনে সম্ভব নয়। ইরানের এই সংকট ক্রমেই আরো অনেক দেশে দেখা যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
এই সংকট মোকাবিলায় এখনই দেশে দেশে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। এর মধ্যে রয়েছে পানি সংরক্ষণের জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, মিঠা পানির উৎস সৃষ্টি করা, সুপেয় পানির প্ল্যান্ট করা, বৃষ্টির পানির সংরক্ষণের ব্যবস্থা, পানির অপচয় রোধ, পানির পুনর্ব্যবহার, বর্জ্যপানি পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং), সমুদ্রের পানি লবণমুক্তকরণ (ডিস্যালিনেশন), পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ, উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ, বৈজ্ঞানিক তথ্যের পর্যাপ্ত ব্যবহার, ব্যক্তি ও সমষ্টিগতভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা।
পানি সংকট মোকাবেলায় ব্যক্তিগতভাবেও আমরা অবদান রাখতে পারি। পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের চলমান জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। এই যেমন– পানির অপচয় রোধ করতে দাঁত ব্রাশ করার সময় ট্যাপ বন্ধ রাখা, প্রয়োজনে টয়লেট ফ্ল্যাশ করা, কাপড় ও থালাবাসন ধোয়ার সময় সতর্ক থাকা, রান্নার সময় পানি নষ্ট না করা, লিক হওয়া ট্যাপ বা পাইপ দ্রুত মেরামত, পানি কখনো ফেলে না দেয়া ইত্যাদি। এছাড়া, স্মার্ট যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং নিজেরা সচেতন হয়ে অন্যদেরও সচেতন করলে পানির অপচয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
প্রতিদিন পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর খাদ্যের পাশাপাশি যা আবশ্যকীয় তা হলো পানি। এক–দুইবেলা খাদ্য না খেয়েও দিব্বি মানুষ বেঁচে থাকছে, কিন্তু পানি ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। আসুন–পানি বাঁচাই, পানিই আমাদের বাঁচাবে।
লেখক: উপ–পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)