পৃথিবীতে যখনই ধর্মের গ্লানি হয় এবং অর্ধম ও পাপ বৃদ্ধিপায়, তখনই আমি অবতীর্ণ হই, আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্টু ও পাপীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপন করি। শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করতে কংস, জরাসন্ধ ও শিশুপাল সহ আরো অনেক অত্যাচারিত রাজাদের ধ্বংস করেন এবং ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জন্ম নিয়ে নিজেই বলে দেন ‘মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়। কিন্তু আমি জন্ম রহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান হয়ে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া দুটোই আমার অলৌকিক লীলা। শ্রীকৃষ্ণ পুরুষোত্তম, পুরুষের মধ্যে যিনি উত্তম, তিনিই পুরুষোত্তম। শ্রীকৃষ্ণ পুরুষোত্তম হয়ে এসেছিলেন মানবের সার্বিক কল্যাণের নিমিত্তে। মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত হয়ে তিনি অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে বিরাজিত। বেদে বলা হয়েছে– ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, নিরাকার, জ্যোতির্ময়, অতি বিরাজমান এবং সর্বশক্তিমান। তিনি সর্বত্র সর্বসময়ে সর্বগুণের অভিব্যক্তিতে উজ্জ্বল। তিনি অপরাজেয়, অপরাজিত, বিশুদ্ধ, লোকহিতৈষী, ন্যায়নিষ্ট, ক্ষমাশীল, নিরপেক্ষ, নিরহংকার, যোগযুক্ত। সকল দিক দিয়ে যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যায় যে, শ্রীকৃষ্ণই হলেন সর্ব বিষয়ে পারদর্শী একমাত্র পুরুষ। কি রাজনীতি, কি সমাজনীতি, কি অর্থনীতি, কি ধর্মনীতি, কি বিজ্ঞান কি সাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই তিনি আজও সর্বনীতি তত্ত্ববেত্তা ও মান মর্যাদাবান পুরুষোত্তমরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই তিনি– ঈশ্বর পরম কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ, অনাদির আদি গোবিন্দ সর্ব কারণ কারণম ।
সমগ্র বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ যাঁর রুপে, গুণে, জ্ঞানে, ত্যাগে, মহিমায় মুগ্ধ, যিনি সনাতন ধর্মের সর্বশ্রেষ্ট প্রবক্তা সামাজিক আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক নব জাগরণের যিনি একমাত্র অগ্রদূত, যিনি অনেকেই রাজা বানিয়েছেন, কিন্তু নিজে কখনও রাজা হননি, তিনিই অনন্ত জগতের প্রাণপুরুষ বিশ্ববিমোহন শ্রীমূর্তি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। দ্বাপরযুগে অসুররূপী রাজশক্তির দাপটে পৃথিবী যখন ম্রিয়মান হয়ে উঠে, ধর্ম ও ধার্মিকেরা অসহায় হয়ে পড়েন, বসুমতী পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন, ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা মিলে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে যান দেবাদিদেব মহাদেরের কাছে, সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের যুগসন্ধিক্ষণে সবাই মিলে বিষ্ণুর বন্ধনা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা মগ্ন হন কঠোর তপস্যায়। ধরনীর দুঃখ–দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে দেবতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি তাঁদের অভয়বানী শোনান এই বলে– সে অচিরেই মানবরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন দেবকীর অষ্টম সন্তান রুপে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণ।
বসুদেবের পুত্র বলে শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেব নামেও ভক্তদের কাছে পরিচিত। সংস্কৃতে ‘কৃষ্ণ’ শব্দের অর্থ ‘কালো’। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে কৃষ্ণকে নীল মেঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। শ্রী কৃষ্ণের জন্ম তাঁর ভক্তদের কাছে ‘জন্মাষ্টমী’ হিসেবে যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। ভাদ্রমাস হলো, ভদ্র+ষ্ণ = ভাদ্র। অর্থাৎ ভাদ্রমাস শুভ বা মঙ্গলের মাস। ভগবান জন্ম নিলেন কংসের কারাগারে। কম্+স = কংস। কম্ মানে কামনা বাসনা। কারাগার থাকে রুদ্ধ, হলো উন্মুক্ত। অর্থাৎ কামনা বাসনাযুক্ত দেহরূপ কারাগারের রুদ্ধ দুয়ার একমাত্র প্রাণ কৃষ্ণের কৃপায় খুলে যায়। অন্যকোনো ভাবে নয়, শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পরে কংসের কারাগার হতে পিতা বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে যায় গোকুলের নন্দালয়ে। শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়ে বিভিন্ন লীলার মাধ্যমে মানবসমাজকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। শ্রীকৃষ্ণের লীলায় দুইটি চিত্র ভেসে উঠে– একদিকে রণভূমি, অন্যদিকে প্রেমভূমি, রণভূমি মানে কুরুক্ষেত্র আর প্রেমভূমি মানে একটি পবিত্রতম স্থান যার নাম ‘মধুর বৃন্দাবন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে শ্রীমদ্ভগবদগীতার উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে মানবসমাজকে অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে যে সত্য এবং ন্যায়ের জয়লাভ হয় সে শিক্ষাই দিয়ে গেছেন।
শ্রীকৃষ্ণের ধর্মতত্ত্ব চিরদিন মানুষকে দিব্যজ্ঞান প্রদান করে। তাঁর প্রেম–পীযুষ ধারায় চিরদিন পাপী–তাপীর শুদ্ধ মরুময় হৃদয়ে শান্তির শীতলতায় স্নিগ্ধ করে। সকলের প্রার্থনা হোম–পৃথিবী থেকে অত্যাচার, অনাচার, হিংসা, হানাহানি, পারস্পরিক ঝগড়া–বিবাদ, রাজনৈতিক অস্থিরতা দূরীভূত হয়ে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক।