ঢাকায় তখন মুষলধারে বৃষ্টি। বর্ষণ উপেক্ষা করে অনেকে এলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। লালনের গানের ভক্ত রইস উদ্দীন বললেন, গানের পাখি ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে আকাশও যেন কাঁদছে।
রাজধানীর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার রাত সোয়া ১০টায় মারা যান ফরিদা পারভীন। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। কথা ছিল, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের এই আয়োজন শুরু হবে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায়। তবে তেজকুনি পাড়ার বাড়ি থেকে ফ্রিজিং গাড়িতে করে কফিন পৌঁছাতে বেলা সোয়া ১১টা বেজে যায়। ততক্ষণে শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা সেখানে জড়ো হয়েছেন। ফরিদা পারভীনের গানের ভক্তরাও অনেকে এসেছেন শহরের নানা প্রান্ত থেকে। খবর বিডিনিউজের।
পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। এই শিল্পীর কথা স্মরণ করতে গিয়ে ভক্তদের অনেকের চোখ ভিজে এলো, কণ্ঠে ভর করল আবেগ। বৃষ্টি উপেক্ষা করেও ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা জানাতে যারা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য দেন ফরিদা পারভীনের স্বামী বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম। তিনি জানান শহীদ মিনার থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে বাদ জোহর জানাজার পর কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে কফিন। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন ফরিদা পারভীন। ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরে জন্ম নেওয়া ফরিদা বেড়ে উঠেন কুষ্টিয়ায়। বাবা ছিলেন চিকিৎসক, মা গৃহিণী। সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়া ফরিদার গানে হাতেখড়ি পাঁচ বছর বয়সে। বাবা–মায়ের উৎসাহে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়া ফরিদার ইচ্ছা ছিল নজরুল সংগীতের শিল্পী হওয়ার। এগোচ্ছিলেনও সেই পথে। ফরিদা বলেছিলেন, স্বাধীনতার বছরখানের পর কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে দোল পূর্ণিমার উৎসবে গুরু মোকছেদ আলী তাকে অনুরোধ করেছিলেন লালনের গান গাইতে। তার ভাষ্য ছিল, তখন আমি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম ঠিক আছে আমাকে একটা গান শিখিয়ে দেন। এরপর ‘বড় অনিচ্ছায় কেবল গুরুর মান রাখতে’ লালনের ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান ফরিদা করেছিলেন। ওই গানই তার শিল্পী জীবনের বাঁক বদলে দেয়। নিজের ভেতরে এক ধরনের ‘অনুরণন’ অনুভব করেন বলে ভাষ্য ছিল তার। ফরিদা বলেছিলেন, যেটা ঐশ্বরিক অনুরণন। আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হলো আমাকে এই গান আরও করতে হবে, এই গান শিখতে হবে। এরপর গুরু আমাকে একটা একটা করে গান শেখাতে লাগলেন। আর এভাবেই লালন গানের শুরু। এখন এই লালন ফকিরই আমাকে সবার প্রাণের মধ্যে উপস্থাপন করেছে। এই গান দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলেই সেদিন ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটি আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন।
ফরিদা পারভীনের আক্ষেপ ছিল, নতুন প্রজন্ম শুদ্ধভাবে লালন চর্চা করছে না। লালনের গান ছাড়াও ফরিদা পারভীনের গাওয়া বেশ কয়েকটি আধুনিক ও দেশের গান জনপ্রিয় হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালন চর্চা ছড়িয়ে দিতে প্রায় ১৬ বছর আগে ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় প্রতিষ্ঠা করা অচিন পাখি সংগীত একাডেমি। লালনের গান গেয়ে ফরিদা কেবল নিজেই জনপ্রিয় হননি, এই সংগীতকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পৌঁছে দিয়েছেন।












