ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জেতা হলো না ব্রাজিলের। মৃত্যু পথযাত্রী কিংবদন্তি পেলেকেও শেষ উপহারটা দেওয়া হলোনা নেইমার ক্যাসিমিরোদের। আরো একবার হতাশ হয়ে ফিরতে হলো সর্বোচ্চ পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নদের। টাইব্রেকার নামক ভাগ্য পরীক্ষায় হেরে গেল ব্রাজিল। আরো একবার নিজেকে জাতীয় বীরে পরিণত করল ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক দমিনিক লিভাকভিচ। জাপানের বিপক্ষে শেষ ষোলর ম্যাচে তিনটি পেনাল্টি শট রুখে দিয়ে আলোডন সৃষ্টি করেছিল এই গোলরক্ষক। গতকাল অবশ্য একটি শট রুখে দিয়েছেন তিনি। আর তাতেই তিনি জাতীয় বীর। কারণ সেই একটি শটই তার দল ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে গেছে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। গত আসরের রানার্স আপরা আরো একবার এগিয়ে গেল ফাইনালের পথে। আর ব্রাজিলকে গত আসরের মত এবারেও বিদায় নিতে হলো কোয়ার্টার ফাইনালে। শ্বাসরূদ্ধকর ১২০ মিনিটের ম্যাচের পর টাইব্রেকারে কপাল পুড়ে নেইমারদের। ব্রাজিল হারে ৪-২ গোলে। শুরুতে রদ্রিগোর শট রুখে দেন ক্রোয়েট গোলরক্ষক আর শেষ মারকুইন্সের শট ফিরে সাইডবারে লেগে। আর সে সাথে ব্রাজিলের কপালও পুড়ে। বিদায় নিতে হয় বিশ্বকাপ থেকে। অথচ নির্ধারিত ৯০ মিনিট এবং অতিরিক্ত ৩০ মিনিটসহ পুরো ১২০ মিনিট দুর্দান্ত খেলা ব্রাজিল হেরে গেল ভাগ্য পরীক্ষায়। ২০০২ সালের পর আরেকটি বিশ্বকাপ জিততে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরো চার বছর। হয়তো পরের বিশ্বকাপে পূরণ হতে পারে সেলেসাওদের হেঙ জয়ের স্বপ্ন। আপাতত বিদায়
ব্রাজিল। বিদায় শৈল্পিক ফুটবলের সারথীরা। আর ক্রোয়েশিয়া টানা দ্বিতীয়বারের মত পৌঁছে গেল সেমিফাইনালে। গত আসরের রানার্সআপরা হয়তো আবারো স্বপ্ন বুনতে পারে আরেকটি ফাইনাল খেলার। দলটির গোলরক্ষকের বীরত্বে ক্রোয়েশিয়ার বিদায় করে দিল ব্রাজিলকে। ফুটবল বিশ্বকে চোখের জলে ভাসিয়ে নেইমাররা বিদায় নিল কাতার বিশ্বকাপ থেকে। এখন দেখার বিষয় ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্ন দৌড় আর কতদূর যায়।
ম্যাচের শুরু থেকে অবশ্য আক্রমণের চেষ্টা করে ক্রোয়েশিয়া। এরপর ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে নেয় ব্রাজিল। সে সুবাধে খেলার পঞ্চম মিনিটে গোলের জন্য প্রথম শট নিয়েছিল ব্রাজিল। তবে ভিনিসিউস জুনিয়রের শট সহজেই ঠেকান ক্রোয়েট গোলরক্ষক দমিনিক লিভাকভিচ। ১৩ মিনিটে নিজেদের প্রথম ভালো সুযোগ পেয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। বল নিয়ে নিজেদের অর্ধ্ব থেকে ব্রাজিলের ডি-বঙ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন ইয়োসিপ ইউরানোভিচ। কিন্তু ভাল জায়গায় বল পেয়েও তা লক্ষ্যে রাখতে পারেনি মিলিতাও। রক্ষা পায় ব্রাজিল। ২০ মিনিটে এগিয়ে যেতে পারতো ব্রাজিল। কিন্তু ডি-বঙের ভেতর থেকে ভিনিসিউসের শট রুখে দেন ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক। কয়েক সেকেন্ড পর নেইমারের শটও চলে যায় গোলরক্ষকের হাতে। ৩০ মিনিটে ক্রোয়েশিয়ার পেরিসিচ দূরপাল্লার যে শট নিয়েছিলেন তা চলে যায় ক্রসবারের অনেক উপর দিয়ে। ৪২ মিনিটে বিপজ্জনক জায়গায় ফ্রি কিক পেয়েছিল ব্রাজিল। কিন্তু গোলরক্ষক বরাবর শট নিয়ে এবারও হতাশ করেন নেইমার। যদিও প্রথমার্ধে বল দখলে কিছুটা এগিয়ে ছিল ব্রাজিল। সে সাথে সুযোগ তৈরি করা ও গোলের জন্য শট নেয়ায়ও। অপরদিকে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না ক্রোয়েশিয়াও। লড়াই করেছে সমানে-সমান। কিন্তু আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণে জমে ওঠা ম্যাচের প্রথমার্ধে জালের দেখা পায়নি কোনো দল। ফলে গোলশূন্যভাবে শেষ হয় প্রথম ৪৫ মিনিট।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই বেশ আক্রমনাত্মক ব্রাজিল। সে সুবাধে এগিয়ে যেতে পারতো এই অর্ধের শুরুতেই। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার ডি-বঙে সৃষ্ট জটলা থেকে ব্রাজিলের একাধিক খেলোয়াড় গোল করতে পারেনি। ফলে হতাশ হতে হয় দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই। ৬৬ মিনিটে সবচাইতে সহজ সুযোগটি হারায় ব্রাজিল। বামপ্রান্ত থেকে বাড়ানো বল ধরে সামনে গোলরক্ষককে একা পেয়েও লুকাস যে শট নেন তা ক্রোয়েট কিপারের গায়ে লেগে প্রতিহত হয়। ৭৫ মিনিটে রিচার্লিশনের বাড়ানো বলে নেইমার যে শট নেন তা ক্রোয়েট কিপারের গায়ে লেগে চলে যায় বাইরে। দ্বিতীয়ার্ধের বাকি সময়ে একের পর এক আক্রমণে ক্রোয়েশিয়াকে তটস্থ করে রাখে ব্রাজির। কিন্তু নেইমার, রিচার্লিশন, লুকাসদের শটের সামনে বাধার দেয়াল হয়ে দাড়ায় ক্রোয়েশিয়ার গোল রক্ষক। ফলে দ্বিতীয়ার্ধেও আর গোল পায়নি ব্রাজিল ফলে নির্ধারিত ৯০ মিনিটেও খেলা থাকে অমীমাংসিত। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে।
অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের প্রথমার্ধেও ব্রাজিলের আধিপত্য। আক্রমণের ধারা অব্যাহত থাকে। তবে গোল পাচ্ছিলনা। শেষ পর্যন্ত আসে সে কাঙ্ক্ষিত গোল। অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ১৫ মিনিটের একেবারে শেষ মিনিটে সতীর্থদের সাথে দেওয়া নেওয়া করে অসাধারণ দক্ষতায় নেইমার বল পাঠান জালে। এগিয়ে যাওয়ার উল্লাস করতে করতেই বিরতিতে যায় ব্রাজিল। ম্যাচ যখন শেষের দিকে গড়াচ্ছিল ব্রাজিল যখন জয়োৎসবে মাতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক তখনই ম্যাচে সবচাইতে বড় নাটকের জন্ম দেন পেটকোভিচ। নিজেদের অর্ধ থেকে বল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে দারুণ এক ক্রস থেকে ব্রাজিল ডি বঙের বাইরে থেকে দুর্দান্ত এক শটে বল জালে পাঠান পেটকোভিচ। খেলায় ফিরে সমতা। এগিয়ে যাওয়ার শেষ সুযোগটা হারায় ব্রাজিল খেলার একেবারে শেষ মুহুর্তে। ডান প্রান্তে ফ্রি কিক থেকে উগে আসা বলে ডি বঙে দাঁড়ানো ক্যাসিমিরো শট নিয়েছিলেন। কিন্তু সে শট প্রতিহত হয় ক্রোয়েট গোলরক্ষকের গায়ে লেগে। ফলে ১-১ সমতায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে।
আর শ্বাসরূদ্ধকর সে টাইব্রেকারে ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয় ক্রোয়েশিয়া। টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়ার প্রথম শটে গোল করেন ভ্লাচিক। কিন্তু ব্রাজিলের রদ্রিগোর শট রুখে দেন ক্রোয়েট গোলরক্ষক। ক্রোয়েশিয়ার দ্বিতীয় শটেও গোল করেন মাজের। ব্রাজিলের দ্বিতীয় শটে গোল করেন ক্যাসিমিরো। মদ্রিচ নেন ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে তৃতীয় শট। সেট্রি গোল। ব্রাজিলের পেদ্রোর শটও খুঁজে নেয় জালের ঠিকানা। ক্রোয়েশিয়ার হয়ে চতুর্থ শটটি নেন ওরচিক। সেটিও গোলে জায়গা করে নেয়। ব্রাজিলের চতুর্থ শটটি নিতে আসেন মারকুইনস। কিন্তু তার শট সাইডবারে লেগে প্রতিহত হলে সেমিফাইনালে পৌঁছে যাওয়ার উল্লাসে মাতে গত আসরের রানার্স-আপ ক্রোয়েশিয়া। আর ব্রাজিল বিদায় নেয় কেঁদে এবং কাঁদিয়ে।