শেখ রাসেল, আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার কনিষ্ঠ পুত্র। বাংলাদেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধুর পর যে নামটি আবেগে ও ভালবাসায় মোহাবিষ্ট করে রেখেছে, সে নামটি শেখ রাসেলের। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভিশপ্ত প্রত্যুষে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার পর শুধু বঙ্গবন্ধুর নামই নয়, নিষিদ্ধ ছিল ১০ বছরের শিশু রাসেলের স্মরণও। তা সত্ত্বেও পরম মমতা ও ভালবাসায় জনমানসের হৃদয়ে স্থান করে নেয় শেখ রাসেল। কিংবদন্তীর মতো শেখ রাসেলের শোকগাথা যুক্ত হয় আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতিতে, গল্পে ও সাহিত্যে। শেখ রাসেলের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড মানুষের মনে যে রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করে, তা ছিল দুর্দমনীয়। কখনো কষ্টের আর্তি নিয়ে, কখনো সভ্য জাতির লজ্জা হয়ে আবির্র্ভূত হয় রাসেলের হত্যাকাণ্ডের দায়। বাংলার দিগন্ত থেকে দিগন্তে জ্বলে ওঠে দ্রোহানলের মতো রাসেল হত্যার বিচারের দাবি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন। রাসেলের বই পড়ে তিনি তাঁর ছায়াসঙ্গী প্রিয়তমা স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেণুকে বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। এই ফিলোসফি শুনে রেণু এতটাই বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর নাম অনুসারে নিজের ছোট ছেলে জন্মের পর তাঁর নাম রাখলেন রাসেল। আপন ভুবনে শিশুরা রাধাধিরাজ। রাসেলও শিশুরাজ্যের রাজা ছিল। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র হিসেবে সমবয়সী কিছু বন্ধুও ছিল তাঁর। সবার সঙ্গেই ছিল সম্ভাব। মানুষকে আকর্ষণ করার অসাধারণ ক্ষমতা তখনই অর্জন করেছিল সে। স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে গৃহশিক্ষক, সবারই পছন্দের শীর্ষে ছিল সে। ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠার পেছনে পরিবার একটি বড় ভূমিকা পালন করে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন একজন আদর্শ মাতা। তিনি তাঁর সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় মানুষ করেছেন। মানবিক মূল্যবোধের অভাবে দানবীয়-চরিত্রগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় শান্ত সমাজ প্রায়ই অশান্ত হয়ে উঠছে।
সেক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম এই রাসেল। সকালে নাশতার জন্য পরোটা ও কবুতরের মাংস ভুনা পরিবারের সবার প্রিয় খাবার হলেও রাসেল কোনো দিন কবুতরের মাংস খেত না। কবুতরের প্রতি তাঁর সে কী মায়া! অনেকে অনেক চেষ্টা করেও তাঁর মুখে এক টুকরা কবুতরের মাংস দিতে পারেনি। রাসেলের মাছ ধরারও খুব শখ ছিল। তবে মাছ ধরার পর আবার তা ছেড়ে দিতেই সে বেশি মজা পেত। এটাই ছিল তাঁর মাছ ধরার খেলা। একবার পরিবারের সবার সঙ্গে রাসেল নাটোরে উত্তরা গণভবনে গিয়েছিল। সেখানও সারাদিন সে মাছ ধরা আর ছাড়াতেই ব্যস্ত ছিল। রাসেলের খুব ইচ্ছা ছিল সে বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে। তাঁকে কেউ জিজ্ঞেস করল, ‘বড় হয়ে তুমি কী হবে’? সে নির্দ্বিধায় বলতো, ‘আমি আর্মি অফিসার হব’।
রাসেলের স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার, কিন্তু সব কিছুই স্তব্ধ হয়ে যায় মানবরূপী দানবের হাতে। বড় বোন ‘হাসুপা’র সঙ্গে রাসেল যদি জার্মানিতে যেতে পারত, হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতো। এই নিষ্ঠুর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড তাঁকে দেখতে হতো না। কোমল মনের এই শিশুটিকে মা-বাবা-ভাই-ভাবি-চাচা সবার নিথর দেহের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে দোতলায় নিয়ে যায় নরপশুরা। কতটা কষ্ট পেয়েছিল। তাঁর চোখের পানি কেমন করে ঝরেছিল। ভাবতেও কষ্ট হয়, কেমন করে এ রকম একটি ফুলের মতো শিশুকে হত্যা করল ঘাতকরা। শেখ রাসেলকে হারানোর কলঙ্গজনক বেদনাময় অমর অনুভূতির মাঝে আমরা দেশে শিশু শিক্ষার মানবিক অবস্থান প্রত্যাশা করি।
একটি সুষম, সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন মানবিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা। সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন শিক্ষার প্রসার ও উৎকর্ষের ওপর নির্ভর করে। আজকের জ্ঞান-নির্ভর সমাজে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির অনেকাংশে আবর্তিত হয় জ্ঞানের বিকাশকে কেন্দ্র করে, দ্রুত পরিবর্তনশীল এ বিশ্বে কঠোর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলেও যুগোপযোগী শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। বিশ্বের সকল দেশেই শিক্ষা প্রদান, প্রচার ও প্রসারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে সরকার। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর অন্যতম হলো শিক্ষা লাভের অধিকার। শিক্ষাই মানুষকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে গড়ে তোলে। রাষ্ট্রে সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য-এ উপলব্ধি চিরন্তন সত্য। এ সত্য উপলব্ধির পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝে। মানুষের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, সকলেই নিজে কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে জীবনে বহুদূর এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখছে। এর বাস্তব চিত্র হলো, আমাদের দেশে দিন দিন শিক্ষার হার বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তুলনামূলক তীব্র হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার প্রতিযোগিতাও। এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখে দেশের নামী-দামী প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের। তারপরও ভর্তিযুদ্ধে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও প্রাণপণ চেষ্টার ঘাটতি খুব কম শিক্ষার্থীর মাঝেই দেখা যায়। ভর্তিযুদ্ধে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত তথা দেশের প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার পরিবারের শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ করে থাকে। দেশের প্রায় সব জেলাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বঞ্চিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় শেখ রাসেলের নামে একটি আন্তর্জাতিকমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দাবী জানাচ্ছি। এক্ষেত্রে সরকার এবং যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের সদিচ্ছাই এই সমস্যার সহজ ও দ্রুত সমাধানের পথ সৃষ্টি করতে পারে।
শেখ রাসেল ছিল এক মানবাত্মার মূর্তপ্রতীক। সে জীবিত না থাকলেও শেখ রাসেল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। অন্তরের গভীরে রাসেলের অবস্থান সুস্পষ্ট হবে। আমাদের এগিয়ে যাবার প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। সকল উদার মানসিকতায়, সহযোগিতা এবং সকল মৌলিক অনুভূতিতে রাসেল স্মরণীয় হবে বহুভাবে। সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে একটি চেতনা জাগ্রত হবে রাসেলের নিষ্পাপ দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে। আমরা মানবতার প্রেমসিন্ধুতে অবগাহন করে পূর্ণ করব রাসেলের প্রত্যাশা। যে প্রত্যাশার বাণী অলৌকিকভাবেই পৌঁছে যাবে শিক্ষার্থীদের দুয়ারে দুয়ারে।
শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরতরাই হয়তো ৪১ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হবে, সেই দেশের কর্ণধার হবে। আবার ২০৭১ সালে আমরা আমাদের স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করবো। আগামী দিনের প্রজন্ম অর্থাৎ প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন শেখ রাসেলকে স্মরণ করে সেটা মাখায় রেখে আমরা শেখ রাসেল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোর দাবি জানাচ্ছি। কেবল জন্মদিন পালনের জাঁকজমক তোড়জোর নয় সৃষ্টির মাধ্যমে অনন্তকাল বুকে ধারণ করার সুযোগ অবারিত করতে হবে। রাসেল হারানোর বেদনায় যে অপরাধবোধ কিছুটা লাঘব হবে, প্রশমিত হবে। নিষ্পাপ-নিরপরাধী শিশু রাসেল জাতীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার বিবেকশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হবে।
লেখক : টেকসই উন্নয়নকর্মী