বড় গ্রামে ছোট শহর : বাংলাদেশের উন্নয়ন বাস্তবতার এক অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ পাঠ

আজহার মাহমুদ | শুক্রবার , ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বড় গ্রামে ছোট শহর” গ্রন্থটি বাংলাদেশের সামাজিকু অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। লেখক মাহমুদুল হক আনসারী এখানে গ্রাম ও শহরের দ্বন্দ্বকে কেবল ভৌগোলিক বিভাজন হিসেবে দেখেননি বরং এটিকে রাষ্ট্রচিন্তা, উন্নয়ন দর্শন এবং নাগরিক জীবনের সংকটের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। বইটির নামই ইঙ্গিত দেয়বাংলাদেশের শহরগুলো আসলে পরিকল্পিত নগর নয়, আবার গ্রামগুলোও আর খাঁটি গ্রাম নেই। বরং পুরো দেশটাই এক ধরনের বড় গ্রাম, যেখানে নাগরিক সুযোগসুবিধাহীন এক অস্বস্তিকর নগরায়ণ চলছে।

সূচিপত্রে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, লেখক উন্নয়নকে একমাত্রিকভাবে দেখেননি। তিনি নাগরিক সেবা, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ, জনসংখ্যা, দুর্নীতি, প্রশাসন, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাসবকিছুকে একটি সামগ্রিক কাঠামোর ভেতরে এনেছেন। “আমার গ্রাম, আমার শহর” কিংবা “নগর জীবনে দুর্ভোগ” শিরোনামগুলো আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। এসব লেখায় শহরের যানজট, জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত আবাসন এবং নাগরিক জীবনের ভোগান্তি বাস্তব উদাহরণসহ উঠে আসে।

বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিকল্পনার অভাব নিয়ে লেখকের সুস্পষ্ট অবস্থান। “নগর সম্প্রসারণে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা” বা “পরিকল্পিত নগরায়ণ চ্যালেঞ্জ ও করণীয়”এই অধ্যায়গুলোতে তিনি দেখান, কীভাবে খণ্ডিত সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক স্বার্থ এবং আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা একটি সম্ভাবনাময় দেশকে অকার্যকর নগরে পরিণত করছে। এখানে লেখক কেবল সমালোচনা করেননি, বরং কি কি করণীয় রয়েছে সেটাও তুলে ধরেছেন।

কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিষয়ক লেখাগুলো বইটির আরেকটি শক্তিশালী দিক। এসব লেখায়, উন্নয়নের নামে কৃষিকে অবহেলা করলে কীভাবে রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। শহরমুখী উন্নয়ন যে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য সংকট ও সামাজিক বৈষম্য বাড়ায়, সে কথাও তিনি যুক্তির সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

দুর্নীতি, প্রশাসন ও রাজনীতি নিয়ে লেখাগুলো বইটিকে আরও গভীর করে তোলে। “উন্নয়ন দুর্নীতি একসাথে নয়”, “দুর্নীতিমুক্ত সমাজে যেতে হলে হবে প্রজন্মকে”এই ধরনের শিরোনাম থেকে বোঝা যায়, লেখক সমস্যার শিকড়কে ব্যক্তি নয়, কাঠামোগত ব্যাধি হিসেবে দেখছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, কেবল আইন বা শাস্তি নয়নৈতিকতা, শিক্ষা ও নাগরিক সচেতনতার মধ্য দিয়েই টেকসই পরিবর্তন সম্ভব।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই বইটি কোনো আবেগী বক্তৃতা বা কেবল অভিযোগের সংকলন নয়। এটি একজন সচেতন নাগরিক ও চিন্তাশীল লেখকের পর্যবেক্ষণ, যিনি মাঠের বাস্তবতা দেখেছেন এবং রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদে ভাবতে ও শিখতে আহ্বান জানিয়েছেন। বইটির ভাষা সরল, বক্তব্য স্পষ্ট, এবং প্রতিটি লেখা আলাদা হলেও একটি অভিন্ন দর্শনে যুক্তবাংলাদেশকে বাসযোগ্য, ন্যায্য ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা।

বড় গ্রামে ছোট শহর” মূলত আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করায়। আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, কীভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দুর্নীতির সঙ্গে আপস করে চলেছি, এবং কোন পথে গেলে এই বাস্তবতা বদলানো সম্ভবএই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি করে বইটি। নীতিনির্ধারক, গবেষক, শিক্ষার্থী কিংবা সচেতন পাঠকসবার জন্যই এটি একটি সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় গ্রন্থ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রমা ও লাবণ্য ছড়ানো সত্তর
পরবর্তী নিবন্ধবিস্ফারিত চোখ বিস্ফোরিত চেতনা