ব্র্যান্ড পার্সোনালিটির আত্মহত্যা: ছোট ভুলে বড় বিপদে পড়তে পারে যে কোনো ব্র্যান্ড

ইমতিয়াজ জিহাদ | শনিবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

বাজারে একটি ব্র্যান্ড কেবল নাম বা লোগো নয়; এটি একটি বিশ্বাস, একটি প্রতিশ্রুতি এবং ভোক্তার মনের ভেতরে গড়ে ওঠা এক ধরনের আবেগী অবস্থান। মার্কেটিং জগতে তাই একটি কথা বহুল প্রচলিত, A brand is a promise. সেই প্রতিশ্রুতি তখনই জীবন্ত থাকে, যখন ব্র্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব চরিত্র, বার্তা ও ভঙ্গিমায় একরূপ থাকে। বাজারের প্রতিযোগিতা কিংবা পরিবর্তিত সময়ে সেই পরিচয় রক্ষা করা সহজ কাজ নয়। বরং ব্র্যান্ড ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে কঠিন অংশই হলো এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা।

বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব বড় ব্র্যান্ড, Nike, Dove, Lux, Lifeboy বা Apple, তাদের সাফল্যের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে একটি বিষয়কে: ব্র্যান্ড পার্সোনালিটি বা ব্র্যান্ডের স্বতন্ত্র চরিত্র। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান জানে, তাদের পণ্যের গুণমান ভিন্ন হতে পারে, দামেও পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু ব্র্যান্ডের চরিত্র বদলে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। কারণ ভোক্তা ব্র্যান্ডকে দেখে মানুষের মতোই, একটি পরিচিত মুখ, যার আচরণ থেকে তিনি নির্দিষ্ট প্রত্যাশা তৈরি করেন।

ব্র্যান্ড পার্সোনালিটি হলো একটি ব্র্যান্ডের এমন মানবিক বৈশিষ্ট্য, যা ভোক্তার মনে একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস, অনুভূতি এবং আস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে। একটি ব্র্যান্ড নিজের ভাষা, ভিজ্যুয়াল, টোন, গল্প এবং আচরণের মাধ্যমে এই চরিত্রকে প্রকাশ করে। Lux যেমন নারীত্ব, গ্ল্যামার এবং সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত; Doveকোমলতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বার্তা দেয়; Appleনিজেকে উপস্থাপন করে উদ্ভাবনী, প্রিমিয়াম এবং মিনিমালিস্ট এক আধুনিক ব্র্যান্ড হিসেবে।

একটি ব্র্যান্ডের এই পরিচয় হঠাৎ করে তৈরি হয় না। বছরের পর বছর ধরে নিরন্তর একই ধরনের বার্তা, একই রকম ভিজ্যুয়াল এবং একই ধরনের অবস্থানের মধ্য দিয়ে এই চরিত্র গড়ে ওঠে। ভোক্তার মনে একবার এই চরিত্র বসে গেলে তা বদলানো অত্যন্ত কঠিন। আর ভুলভাবে বদলাতে গেলে, তা ব্র্যান্ডের জন্য ডেকে আনতে পারে বড় বিপর্যয়।

সামপ্রতিক সময়ে দেখা গেছে, কিছু জনপ্রিয় ব্র্যান্ড তাদের দীর্ঘদিনের গড়া অবস্থান থেকে সরে গিয়ে এমন বার্তা ব্যবহার করছে, যা তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারা হয়তো একদিকে নিজেদের পরিচয় তৈরি করেছে সৌন্দর্য বা কোমলতার প্রতীক হিসেবে, আবার হঠাৎ করে শুরু করেছে ‘জার্ম প্রোটেকশন’ বা ‘পাওয়ার স্ট্রেংথ’এর মতো বিপরীতধর্মী বার্তা দেয়া। এতে ভোক্তা প্রথমে বিভ্রান্ত হয়, তারপর জন্ম নেয় সন্দেহ। এবং সন্দেহ গ্রাহকের সিদ্ধান্তে সরাসরি প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশের বর্তমান বাজারের দিকে তাকালেও দেখা যায়, ব্র্যান্ড পার্সোনালিটির এই অসামঞ্জস্যতা দ্রুত বাড়ছে। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের যুগে ব্র্যান্ডগুলো দ্রুত রিচ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে, এবং সেখানেই ঘটে সবচেয়ে বড় ক্ষতি। অ্যালগরিদমভিত্তিক এই পরিবেশে মার্কেটাররা প্রায়ই মনে করেন, ‘যা ট্রেন্ড, তাই বলতে হবে।’ ফলে ব্র্যান্ডের মূল চরিত্র ভেঙে গিয়ে শুরু হয় অতিরিক্ত দাবি, অপ্রাসঙ্গিক বার্তা এবং সবার মতো হওয়ার তাড়না।

এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাজেটের বাস্তবতা। কম খরচে বেশি মনোযোগ পেতে গিয়ে অনেক ব্র্যান্ড হঠাৎ টোন বদলে ফেলে, অথচ সেই টোন ব্র্যান্ডের স্বভাবের সঙ্গে যায় কি না, তা বোঝার প্রয়োজন বোধ করে না। এর ফলে ভোক্তার মনে ব্র্যান্ডের কোনো স্থায়ী ছাপ তৈরি হয় না; বরং প্রতিটি বিজ্ঞাপন যেন নতুন ব্র্যান্ড থেকে আসছে বলে মনে হয়। মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা একে বলেন, Brand Fragmentation এটি দীর্ঘমেয়াদে ব্র্যান্ডের পরিচয়কে দুর্বল করার পাশাপাশি প্রতিযোগীদের জন্য সুযোগও বাড়িয়ে দেয়।

মার্কেটিং তত্ত্বে বহু আগে থেকেই একটি ধারণা প্রচলিত, ‘Strategy is sacrifice.’ অর্থাৎ, একটি ব্র্যান্ড সবকিছু বলতে পারে না। বরং তাকে খুব সচেতনভাবে নির্বাচন করতে হয় যে সে কী বলবে এবং কী বলবে না। স্ট্র্যাটেজির মূল শক্তিই হলো এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। তাই মার্কেটিং লিডাররা বরাবরই বলেন, “A brand is built by what you decide NOT to do.”

যখন কোনো ব্র্যান্ড তার পণ্যের সুবিধা দেখাতে গিয়ে সব ধরনের বার্তা একসঙ্গে বলতে চায়, তখনই ঘটে বিপর্যয়। ব্র্যান্ড অযথা বহুমুখী হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে নিজের চরিত্রের স্পষ্টতা। আর ব্র্যান্ডের চরিত্র ঝাপসা হয়ে যাওয়া মানেই ভোক্তার মনে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা।

মার্কেটিংয়ের বড় একটি সমস্যাই হলো, অতি স্বল্পমেয়াদী বিক্রি বা ট্রেন্ডের লোভ। কোনো ব্র্যান্ড যদি মুহূর্তের সুবিধা নিতে গিয়ে নিজের চরিত্র থেকে সরে আসে, তখন সেই সিদ্ধান্ত হয়তো সাময়িকভাবে কিছু রিচ, আলোচনা বা বিক্রি বাড়াতে পারে। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব অনেক বেশি গভীর। কারণ এতে ব্র্যান্ডের ইকুইটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইকুইটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্র্যান্ডের মূল্য, গ্রাহকের আস্থা এবং বাজারে অবস্থান, সবকিছুই ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।

অনেক বড় আকারের ব্র্যান্ড ইতিহাসে এই ভুল করেছে, এবং সাময়িক জনপ্রিয়তার বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদে হারিয়েছে নিজেদের শক্তি ও অবস্থান। বাজারে টিকে থাকা মানে কেবল বিক্রি নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদে আস্থা, চরিত্র এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। ব্র্যান্ড বদলাতে পারে, কিন্তু কীভাবে?

বাজার সময়ের সঙ্গে বদলায়, প্রযুক্তি বদলায়, ভোক্তার প্রয়োজনও বদলায়। তাই ব্র্যান্ডেরও পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু সেই পরিবর্তন হতে হবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও বাস্তবসম্মত। প্রথমত, পরিবর্তন হতে হবে ধীরে। ভোক্তা যেন চরিত্রের ভাঙন না দেখে, বরং একটি স্বাভাবিক বিবর্তন অনুভব করে। দ্বিতীয়ত, পরিবর্তন হতে হবে গবেষণার ভিত্তিতে। ভোক্তা কী চায়, বাজার কী নির্দেশ দিচ্ছে এবং প্রতিযোগীরা কী করছে, এসব বিবেচনায় না রেখে পরিবর্তন করা বিপজ্জনক। তৃতীয়ত, পরিবর্তন হতে হবে ব্র্যান্ডের মূল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। চরিত্র পুরোপুরি বদলে ফেললে তা আর বিবর্তন থাকে না; বরং তা হয়ে দাঁড়ায় পরিচয় সংকট।

একটি দীর্ঘদিনের কোমল বা গ্ল্যামারাস ব্র্যান্ড হঠাৎ করে শক্তি, ভয়ভীতি বা প্রতিরোধের ভাষায় কথা বলা শুরু করলে ভোক্তা সেটিকে পছন্দে নেয় না। কারণ এতে চমক তৈরির বদলে তৈরি হয় প্রশ্ন, এই ব্র্যান্ড আসলে চাইছে কী?

ব্র্যান্ড যত বড়ই হোক, যত পুরোনোই হোক, তার শক্তি নির্ভর করে একটি বিষয়েই: ব্যক্তিত্বের স্থায়িত্ব। ব্র্যান্ডের ব্যক্তিত্ব যদি ভেঙে যায়, তাহলে সেটি আর ব্র্যান্ড হিসেবে টিকে থাকতে পারে না। তখন এটি কেবল একটি পণ্য হয়ে দাঁড়ায়, যার সমান প্রতিযোগী বাজারে অসংখ্য।

মার্কেটিংয়ের এই কঠিন সত্যটি বোঝা জরুরি যে, একটি ভুল বার্তা, একটি ভুল ক্যাম্পেইন বা একটি ভুল কৌশল কখনো কখনো বহু বছরের তৈরি ব্র্যান্ড মূল্যকে মুহূর্তেই নষ্ট করে দিতে পারে। তাই প্রতিটি সিদ্ধান্তই নিতে হবে সতর্কভাবে। প্রতিটি বার্তা, প্রতিটি ভিজ্যুয়াল, প্রতিটি প্রচারকের আগে একটি প্রশ্ন জরুরি, এটি কি আমাদের ব্র্যান্ডের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলছে? যদি উত্তর হয় না, তাহলে সেই বার্তা যতই আকর্ষণীয় হোক, সেটিকে এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়।

আজকের দিনে ব্র্যান্ড শুধু পণ্যের নাম নয়; এটি একটি আবেগ, একটি প্রতিশ্রুতি এবং বহু বছরের শ্রমে গড়ে ওঠা একটি চরিত্র। এই চরিত্র রক্ষা করা না গেলে ব্র্যান্ডের অস্তিত্বই ঝুঁকির মুখে পড়ে। বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, ভোক্তা আরও সচেতন হচ্ছে, এই সময়ে ব্র্যান্ডের সঠিক পথ বেছে নেওয়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, দিনের শেষে শিক্ষা একটাইঃ যেই ব্র্যান্ড নিজের চরিত্র ধরে রাখতে পারে, সেই ব্র্যান্ডই টিকে থাকে। আর যে ব্র্যান্ড পারে না, সেই ব্র্যান্ডের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়ে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক; লীড বাংলাদেশ লিঃ, চীফ ক্রিয়েটিভ অফিসার ও প্রতিষ্ঠাতা; লীড মার্কেটিং ইনকর্পোরেশন; কানাডা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধআল কোরআনের শাসনেই ইনসাফের রাজ কায়েম হবে