জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ৯০ শতাংশেরই একটা সময়ে ব্র্যাকিথেরাপি নিতে হয়। অর্থাৎ জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তদের জন্য এই থেরাপি অনেকটা অপরিহার্য। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওথেরাপি (ক্যান্সার) ওয়ার্ডে থাকা একমাত্র ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি এক বছরেও সচল হয়নি। কয়েকটি পার্টস নষ্ট হওয়ায় গতবছরের (২০২২ সালের) ৬ জুন থেকে মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
ফলে বছরের বেশি সময় ধরেই ব্র্যাকিথেরাপি সেবাও বন্ধ রয়েছে এ হাসপাতালে। এতে করে চরম ভোগান্তির পাশাপাশি অসহায় হয়ে পড়েছেন জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত চট্টগ্রামের রোগীরা। চিকিৎসকরা বলছেন, চমেক হাসপাতাল ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামের অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে এই ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন নেই। কিন্তু এ অঞ্চলের একমাত্র মেশিনটি (চমেক হাসপাতালের) অচল থাকায় বাধ্য হয়ে ঢাকায় গিয়েই এই ব্র্যাকিথেরাপি সেবা নিতে হচ্ছে বৃহত্তর চট্টগ্রামের রোগীদের। এদিকে, মেশিনটি সচল করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিএমএসডি (কেন্দ্রীয় ওষুধাগার)’র সাথে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় চিঠি চালাচালি করলেও এখন পর্যন্ত ইতিবাচক কোনও ফল পাওয়া যায়নি। বলতে গেলে মেশিনটি সহসা সচলকরণের বিষয়েও নিশ্চিত কোনও তথ্য দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
মেশিনটি অকেজো হওয়ার পরপরই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে বিষয়টি অবহিত করা হয় বলে জানান রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ। আর এ বিষয়ে সিএমএসডি (কেন্দ্রীয় ওষুধাগার)’র সাথে দফায় দফায় যোগাযোগ রাখা হচ্ছে জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, ডিপার্টমেন্ট থেকে জানার পরই বিষয়টি আমরা সিএমএসডি– কে লিখিত ভাবে জানাই। মাঝখানে মেশিনটি সচল হয়েছে কী না, তা চিঠি দিয়ে সিএমএসডি আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। তবে মেশিনটি সচল না হওয়ার বিষয়টি আমরা পুনরায় সিএমএসডি–কে জানিয়ে দিই।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মেশিনটি সচলকরণে সিএমএসডি’র পক্ষ থেকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কয়েক দফায় তাগাদা দেয়া হয়। তবে মেশিনটি সরবরাহ বাবদ বিলের একটি অংশ এখনো না পাওয়ায় (বকেয়া থাকায়) মেশিন সচলকরণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে আসছে না। প্রতিষ্ঠানটি আগে বকেয়া বিল পরিশোধের দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও গতবছরের শেষ দিকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে বকেয়া বিল নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এর প্রেক্ষিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে মেশিনটি সচল হবে মর্মে আশার কথা শুনিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তবে সে–ই আশাবাদ আশাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। মেশিনটি অদ্যবধি সচল হয়নি।
ক্যান্সার ওয়ার্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, থেরাপি সেবা দেওয়ার সময় গতবছরের ৬ জুন ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি হঠাৎ করে অকোজে হয়ে পড়ে। এর পরপরই
মোবাইল ও ই–মেইলের মাধ্যমে মেশিনটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি জানানো হয়। ১৫ জুন তাদের (সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের) প্রকৌশলী এসে মেশিনটি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেন। নষ্ট হওয়ায় তারা মেশিনটির কয়েকটি পার্টস (টাউথ বেল্ট ও লাইট বেরিয়ার) পরিবর্তন ও সার্ভিসিংয়ের কথা বলেন।
বিষয়টি ১৬ জুন লিখিত ভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে রেডিওথেরাপি বিভাগ। এর প্রেক্ষিতে ২১ জুন সিএমএসডির পরিচালক বরাবর চিঠি দেয় হাসপাতাল প্রশাসন। হাসপাতালের উপ–পরিচালক ডা. অং সুই প্রু মারমার স্বাক্ষরে ওই চিঠি দেয়া হয়। ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে জরুরি ভিত্তিতে মেশিনটি মেরামতের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে। এ নিয়ে গতবছরের ২৬ জুলাই দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘৬ কোটি টাকার ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন দুই মাস ধরে অচল/চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তবে এরপর আরো দশ মাস কেটে গেলেও মেশিনটি সচল হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেডিওথেরাপি বিভাগে সপ্তাহে দুদিন এই ব্র্যাকিথেরাপি সেবা দেয়া হয়ে থাকে। জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩–৪ বার এ ব্র্যাকিথেরাপি দিতে হয়। প্রতিবার থেরাপিতে খরচ পড়ে দেড় হাজার টাকা। চট্টগ্রামের সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে অন্য কোনও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় কোনও ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন নেই। দ্বিতীয় কোনও মেশিন না থাকা এবং চমেক হাসপাতালের একমাত্র মেশিনটির সেবা বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামের জরায়ু ক্যান্সারের রোগীরা কষ্টে পড়েছেন। বলতে গেলে জরায়ু ক্যান্সারের এসব রোগী অসহায় হয়ে পড়েছেন। ব্র্যাকিথেরাপি নেয়া জরুরি, এমন রোগীদের ঢাকায় গিয়ে এই থেরাপি নেয়া ছাড়া উপায় নেই।
জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৯০ শতাংশ রোগীর এই ব্র্যাকিথেরাপি গ্রহণ অপরিহার্য জানিয়ে রেডিওথেরাপি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলছেন, জরায়ু ক্যান্সার ছাড়াও খাদ্যনালীর ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার ও জিহ্বার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের যাদের বাইরে থেকে রেডিওথেরাপি দিয়েও কাজ হয় না এবং যাদের অপারেশনও করা যায় না, সেসব রোগীকে ব্র্যাকিথেরাপি দেওয়ার সুযোগ থাকে।
এই অঞ্চলের জরায়ু ক্যান্সার রোগীদের স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে এই ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন সচল করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ক্যান্সার ওয়ার্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মো. ইউসুফ।
জানতে চাইলে মেশিনটি সচলের বিষয়ে সর্বশেষ কয়দিন আগেও মন্ত্রণালয় ও সিএমএসডি’র সাথে কথা বলেছেন দাবি করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, সিএমএসডির পক্ষ থেকে বারবার আমাদের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুরাহা হচ্ছে না। চিঠি, ফোনের পাশাপাশি ঢাকায় গিয়ে বেশ কয়বার সরাসরি এ বিষয়ে কথাও বলেছি। মেশিনটি দ্রুত সচলকরণের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে নিজেরাও এক প্রকার অসহায় বলে মন্তব্য করেন হাসপাতাল পরিচালক।
উল্লেখ্য, চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে নতুন স্থাপন করা এই ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনের আনুষ্ঠানিক সেবা চালু হয় ২০১৯ সালের মে মাসে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা এর সেবা পেতে শুরু করেন। তবে চালুর পরও বিভিন্ন সময় পার্টস নষ্টের কারণে মেশিনটির সেবা বন্ধ থাকে। সর্বশেষ গত বছরের জুন মাস থেকে মেশিনটির সেবা বন্ধ রয়েছে।